বাস্তব গ্যাসের বিচ্যুতির কারন, বাস্তব গ্যাস আদর্শ আচারনের শর্ত, গ্যাস তরলীকরণের মূলনীতি

প্রশ্ন: আদর্শ আচারন থেকে বাস্তব গ্যাসের বিচ্যুতির কারন ব্যাখ্যা কর ।

আথবা,  বাস্তব গ্যাসের জন্য ভ্যান্ডার ওয়ালস্ সমীকরণ প্রতিপাদন কর

উত্তর :-

গ্যাসের যে গতিতত্ত্ব হতে গ্যাসীয় সূত্রগুলো প্রতিপাদন করা যায়, সেই গতিতত্ত্বে দুটি প্রধান ত্রুটি আছে যার ফলে বাস্তব গ্যাসসমূহ আদর্শ আচরণ থেকে বিচ্যুতি প্রদর্শন করে। বিজ্ঞানী ভ্যান্ডার ওয়ালস্ ঐ ত্রুটি দুটি সংশোধন করে বাস্তব গ্যাসের জন্য একটি পরিবর্তিত বা সংশোধিত সমীকরণ প্রস্তাব করেন। তার মতে, আদর্শ গ্যাস সমীকরণ PV = RT-তে আয়তন ও চাপ সংশোধনী প্রয়োগ করলেই সমীকরণটি বাস্তব গ্যাসের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে। তার নামানুসারেই সংশোধিত সমীকরণটি ভ্যান্ডার ওয়ালস্ সমীকরণ (Van der Waal’s equation) নামে পরিচিত ।

 আদর্শ গ্যাসের আচরণ থেকে বাস্তব গ্যাসের বিচ্যুতির কারণ:-

 বাস্তব গ্যাস গতিতত্ত্বের প্রধান দুটি স্বীকার্য মেনে চলে না । অর্থাৎ ভিন্নতা প্রদর্শন করে । তাই আদর্শ গ্যাসের আচরণ থেকে বাস্তব গ্যাস বিচ্যুতি প্রদর্শন করে। আর এই বিচ্যুতি প্রদর্শনের কারণ দুটি। যথা:-

১. আয়তন ত্রুটি : গতিতত্ত্বের একটি স্বীকার্যে বলা হয়েছে গ্যাসের অনুসমূহের আয়তন গ্যাসাধারের তুলনায় অতি নগন্য। কিন্তু উচ্চ চাপে ও নিম্ন তাপমাত্রায় এ স্বীকার্যটি মোটেও সত্য নয় । কারণ :

 (i) উচ্চ চাপে ও নিম্ন তাপমাত্রায় অল্প পরিসরে অধিক সংখ্যক গ্যাসাণু বিদ্যমান।

আর এমতাবস্থায় গ্যাসের অনুসমূহের আয়তনকে গ্যাসাধারের আয়তনের তুলনায় , নগন্য বলে উপেক্ষা করা যায় না।

 (ii) উচ্চ চাপে ও নিম্ন তাপমাত্রায় গ্যাসকে তরল এমনকি কঠিনেও পরিণত করা যায় । যে পদার্থের তরল এবং কঠিন অবস্থায় আয়তন আছে গ্যাসীয় অবস্থায়ও নিশ্চয়ই উহার আয়তন আছে। এছাড়া

 (iii) অ্যাভেগেড্রোর প্রকল্প অনুসারে N.T.P তে 1 মো্ল গ্যাসের আয়তন 22.4L,যা অদ্যবধি সর্বজন স্বীকৃত এবং নির্ভুলভাবে প্রমাণিত। অতএব সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, অবশ্যই গ্যাসের আয়তন বিদ্যমান। কাজেই আদর্শ গ্যাসের অবাধ বিচরণের জন্য যে আয়তন (V) ধরা হয়েছে, বাস্তব গ্যাসের জন্য তা উক্ত আয়তন অপেক্ষা কিছুটা কম হবে।

যদি গ্যাসাধারের আয়তন = V এবং 1 মো্ল গ্যাসের কার্যকরী আয়তন = b হয়। তবে 1 মোল গ্যাসের প্রকৃত আয়তন = V – b

আবার, যদি n মো্ল গ্যাসের কার্যকরী আয়তন = nb হয় তবে n মোল গ্যাসের প্রকৃত আয়তন = v – nb ।

 ২. চাপ ত্রুটি : গতিতত্ত্বের আর একটি স্বীকার্য হচ্ছে গ্যাসের অণুসমূহের মধ্যে কোন আকর্ষণ বা বিকর্ষণ নেই । কিন্তু উচ্চ চাপে ও নিম্ন তাপমাত্রায় এ স্বীকার্যটিও সঠিক নয়। কারণ উচ্চ চাপ ও নিম্ন তাপমাত্রায় গ্যাসের অণুসমূহের গতিশক্তি যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস পায়, আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বৃদ্ধি পায় এবং এক পর্যায়ে তরল অথবা কঠিনেও পরিণত হয়; যা অনুসমূহের মধ্যে আকর্ষণ না থাকলে সম্ভব হতো না। এ থেকে প্রমাণিত হয়,গ্যাসানুসমূহের মধ্যে অবশ্যই আকর্ষণ বিদ্যমান। আকর্ষণ না থাকলে আদর্শ অবস্থায় অনুসমূহ গ্যাসাধারের গায়ে যে চাপ প্রয়োগ করত বাস্তব গ্যাসের অণুসমূহের মধ্যে আকর্ষণ বিদ্যমান থাকায় কিছু পরিমাণ কম চাপ প্রয়োগ করবে। যদি আকর্ষণমুক্ত আদর্শ অবস্থায় গ্যাসের চাপ = P

বাস্তবগ্যাসের আকর্ষণ হেতু কমতি চাপ অন্ত:টান আর্কষন বল = pa হয়

তবে, বাস্তব গ্যাসের প্রকৃত চাপ = P + Pa

                                       = P + an2/V2

n মোল বাস্তব গ্যাসের  সমীকরণ (V – nb)( P + an2/V2) = nRT

প্রশ্ন:  কোন কোন শর্তে বাস্তব গ্যার আদর্শ গ্যাসের মত আচারন করবে ব্যাখ্যা কর ।

উত্তর :-

অত্যন্ত নিম্ন চাপ ও উচ্চ তাপমাত্রায় বাস্তব গ্যাসগুলির আদর্শ গ্যাসের মতো আচরণ প্রদর্শন করার ।

ব্যাখ্যা:-

i. অত্যন্ত নিম্ন চাপ :- অত্যন্ত নিম্ন চাপে গ্যাসের আয়তনের মান বেশি হয়। ফলে গ্যাস অণুগুলোর মধ্যেকার দূরত্ব খুব বেশি হয়। এর ফলে গ্যাস অণুগুলোর মধ্যকার আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বল খুবই কম হয় এবং a এর ক্ষুদ্র মান ও V এর বৃহৎ মানের জন্য a/V2 পদটির মান অত্যন্ত কম হয়। তাই a/V2  পদটিকে P এর সাপেক্ষে অগ্রাহ্য করা যায়। আবার, V এর বৃহৎ মানের জন্য b এর মানকে ল V র সাপেক্ষে অগ্রাহ্য করা যায় । সুতরাং অত্যন্ত নিম্ন চাপে (P + a/V2 ) ≈ P এবং (V – b) ≈V । এই অবস্থায় ভ্যান্ডার ওয়ালস সমীকরণটির রূপ হয় PV = RT। কাজেই খুব নিম্ন চাপে বাস্তব গ্যাস আদর্শ গ্যাসের মতো আচরণ করে।

ii. উচ্চ তাপমাত্রায় :- উচ্চ তাপমাত্রায় গ্যাসের আয়তন অত্যন্ত বেশি হয়। আবার, খুব উচ্চ তাপমাত্রায় গ্যাস অণুগুলির গতিশক্তি এত যে এই গতিশক্তি গ্যাস অণুগুলোর মধ্যেকার আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বলকে সহজেই অতিক্রম করে। ফলে খুব উচ্চ তাপমাত্রায় a/V2 এর মান P এর সাপেক্ষে নগণ্য হয় । আবার আয়তনের (V) বৃহৎ মানে b এর মানও V সাপেক্ষে নগণ্য হয়।  সুতরাং খুব উচ্চ তাপমাত্রায় (P + ) ≈ P এবং (V – b) ≈ V এই অবস্থায় ভ্যানডার ওযালস সমীকরণের রূপ হয়  PV = RT। তাই খুব উচ্চ তাপমাত্রায় বাস্তব গ্যাস আদর্শ গ্যাসের মতো আচরণ করে ।

প্রশ্ন: গ্যাস সিলিন্ডারজাতকরণে মূলনীতি ব্যাখ্যা কর।

উত্তর:

১. বয়েল ও চার্লসের সূত্র প্রয়োগে : বয়েল ও চার্লসের সূত্র প্রয়োগ করে বিভিন্ন গ্যাসের সংনমন করা এবং তরলীকরণ সম্ভব। গতিতত্ত্বের স্বীকার্য অনুসারে তাপমাত্রা কমলে, গ্যাসাণুর গতিশক্তি কমতে থাকে এবং যথেষ্ট নিম্নতাপমাত্রায় (সন্ধি তাপমাত্রা  বা তার নিচের তাপমাত্রা ) গ্যাসাণু পরস্পর নিকটে আসে এবং এদের মধ্যে আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বল বৃদ্ধি পায় ফলে গ্যাস তরলে পরিণত হয়। তবে আসল কথা হলো বয়েলের সূত্রানুসারে ( V∞ 1/p) অতি উচ্চ চাপে গ্যাসের আয়তন কমে ফলে গ্যাস অণু কাছাকাছি চলে আসে আন্তঃআণবিক বল বৃদ্ধি পাওয়ায় তা তরলে পরিণত হয় এবং এই কার্যনীতি প্রকাশ করে গ্যাস সিলিন্ডারজাতকরণ করা যায়।

তবে কেবলমাত্র চাপ প্রয়োগ করেই সকল গ্যাস তরল নাও হতে পারে। সত্যিকার অর্থে চাপ প্রয়োগের পাশাপাশি গ্যাসের তাপমাত্রা হ্রাস করতে হয়। গ্যাসের গতিতত্ত্ব অনুসারে গ্যাসের তাপমাত্রা সন্ধি তাপমাত্রা থেকে কমতে থাকলে গ্যাসের অণুসমূহের গতিশক্তিও কমতে থাকে এবং সাথে সাথে গ্যাসের আয়তন কমে যায় (V ∞T) এটি চার্লসের সত্রের একটি বিশেষ রূপ। এখানে যুক্তি হলো যথেষ্ট কম তাপমাত্রার কাছাকাছি আসা অল্প গতিবিশিষ্ট গ্যাসাণুগুলো পরস্পরের আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বলকে বাধা দিতে পারে না বিধায় এই বলের প্রভাবে নিকটে আসা গ্যাস চার্লসের সুত্রমতে তরলে পরিণত হয়।

২. হিম মিশ্রণের ব্যবহার বা ফ্যারাডে পদ্ধতি : হিম মিশ্রণ ব্যবহার করে গ্যাসের তাপমাত্রা হ্রাস করে গ্যাসকে তরল করা যায়। তবে হিম মিশ্রণ ব্যবহার করে তাপমাত্রা খুব বেশি নিচে নামানো যায় না। তাই কেবল সীমিত সংখ্যক কিছু গ্যাস যেমন- CO2, NH3, Cl2, ইত্যাদির ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়। এ পদ্ধতিতে NaCl ও বরফের মিশ্রণ ব্যবহার করে –20°C এবং বিগলিত CaCl2 ও বরফের মিশ্রণ ব্যবহার করে -54°C এবং কঠিন CO2 ও ইথার মিশ্রণ ব্যবহার করে –110°C পর্যন্ত তাপমাত্রা নামানো যায়। বিজ্ঞানী ফ্যারাডে এ পদ্ধতি ব্যবহার করে গ্যাস তরল করেন।

৩. লিন্ডে পদ্ধতি : বিজ্ঞানী লিন্ডে জুল থমসন প্রভাব প্রয়োগ করে গ্যাস তরলীকরণ করেন। জুল থমসন প্রভাব হলো একটি  গ্যাসকে অত্যধিক সংকুচিত করার পর হঠাৎ সম্প্রসারণ করা হলে গ্যাসের তাপমাত্রা হ্রাস পায়। এর কারণ সংকুচিত অবস্থায় গ্যাসের অণুসমূহের মধ্যে তীব্র আন্তঃকণা আকর্ষণ শক্তি বিরাজ করে। সম্প্রসারণের সময় অণুসমূহ পরস্পর হতে দূরে সরে যেতে থাকে বলে আন্তঃআণবিক আকর্ষণের বিপরীতে কাজ করতে হয়। এ কাজের জন্য যে শক্তি প্রয়োজন হয় তা গ্যাসের ভেতর থেকে শোষিত হয়। এজন্য জুল থমসন প্রভাবে গ্যাসের তাপমাত্রা হ্রাস পায়। এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে বিজ্ঞানী লিন্ডে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গ্যাস তরলীকরণ করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এ পদ্ধতিতে একটি গ্যাসকে বারবার সংকুচিত ও সম্প্রসারিত করা হলে জুল থমসন প্রভাব অনুসারে তার তাপমাত্রা হ্রাস পেতে পেতে যখন সন্ধি তাপমাত্রায় পৌঁছায় তখন গ্যাস তরলে পরিণত হয়।

Leave a Reply