জৈব রসায়ন (ORGANIC CHEMISTRY)
সকালে ঘুম থেকে ওঠে শুরু হয় জৈব যৌগের ব্যাবহার এবং ঘুমিয়ে থাকা এসব কিছুতেই জৈব যৌগের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। তোমার চোখের সামনে তুমি যা কিছু দেখছ তার অধিকাংশই জৈব যৌগ বা জৈব পলিমার । তুমি যখন ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখ তার পিছনেও কিন্তু জৈব যৌগের ভূমিকা রয়েছে। অতএব জৈব যৌগ ছাড়া তোমার জীবন যেমন সৃষ্টি হবে না। তেমনি জৈব যৌগ ছাড়া জীবন সামনে অগ্রসর হবে না। মানুষ এ কথা জানতে পেরেছে তা কিন্তু খুব বেশি দিন আগে নয়। তবে সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ এগুলো ব্যবহার করে আসছে । প্রায় দশ হাজার বছর আগে থেকেই তা মানুষ বুঝতে শুরু করেছে ।
উৎপত্তি ও প্রাণশক্তি মতবাদ : বিজ্ঞানী বার্জেলিয়াস ১৮০৭ খ্রি. সর্বপ্রথম, প্রাণ স্পন্দনের অধিকারী সজীব পদার্থ উদ্ভিদ ও প্রাণিদেহে অবিরাম উৎপন্ন যৌগসমূহকে জৈব যৌগ নামে নামকরন করেন।
যেমন: উদ্ভিদের পাতায় সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় কার্বোহাইড্রেট উৎপন্ন হয়
আবার, শিকড়ের সাহায্যে মাটি থেকে গৃহীত নাইট্রেট লবণ এ উদ্ভিদ দেহেই অণুজীবের প্রভাবে প্রোটিনে পরিণত হয়।
এসব পর্যবেক্ষণ থেকে বার্জেলিয়াস ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, “জৈব যৌগসমূহ” উদ্ভিদ ও প্রাণিদেহে উপস্থিত কোন রহস্যময় প্রাণশক্তির প্রভাবে সৃষ্টি হয়ে থাকে। পরীক্ষাগারে এদের প্রস্তুত করা সম্ভব নয়। এই মতবাদ বার্জেলিয়াসের প্রাণশক্তি মতবাদ (Vital force theory) নামে পরিচিত।
বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক ভোলার সর্বপ্রথম 1828 সালে প্রাণশক্তি মতবাদ ভুল প্রমাণিত করেন। তিনি NH4Cl দ্রবণে Pb(CNO)2 দ্রবণ যোগ করে PbCl2 এর সাদা অধঃক্ষেপ এবং অ্যামোনিয়াম সায়ানেট (NH4CNO) দ্রবণ প্রস্তুত করেন। পরে পরিস্রাবণ করে যখন, অ্যামোনিয়াম সায়ানেট (NH4CNO) দ্রবণ পৃথক করে, উত্তপ্ত করে যখন একে সম্পৃক্ত দ্রবণ তৈরি করেন তখন অনাকাঙিক্ষতভাবে ইউরিয়া প্রস্তুত হয় ।
ফ্রেডরিক ভোলারে মতে জৈব যৌগসমূহ শুধু মাত্র উদ্ভিদ ও প্রাণিদেহে উপস্থিত কোন রহস্যময় প্রাণশক্তির প্রভাবে সৃষ্টি হবে এমন নয় এটি পরীক্ষাগারেও সংশ্লেষন করা সম্ভব। বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক ভোলার এইভাবে প্রাণশক্তি মতবাদ ভুল প্রমাণ করেন।
প্রাচীন ধারণা মতে জৈব যৌগকে নিম্নরূপে সংজ্ঞায়িত করা হয়, ‘উৎস ও প্রস্তুত পদ্ধতি নির্বিচারে কার্বনের সঙ্গে অন্য এক বা একাধিক মৌলের সমন্বয়ে গঠিত যৌগকে জৈব যৌগ বলে।
যেমন: CH4, CH3OH,CH3NH2,CHCl3 ইত্যাদি সবই জৈব যৌগ। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হলো: কার্বনের অক্সাইড, সালফাইড, সায়ানাইড, ধাতু কার্বাইড ইত্যাদি কার্বনের যৌগ হলেও জৈব যৌগ নয়।
তাই বর্তমানে তথা সর্বাধুনিক যুগে জৈব যৌগকে নিম্নরূপে সংজ্ঞায়িত করা হয়, শুধুমাত্র কার্বন ও হাইড্রোজেন দ্বারা গঠিত যৌগকে হাইড্রোকার্বন বলে; আর এই হাইড্রোকার্বন ও হাইড্রোকার্বন থেকে সৃষ্ট যৌগকে জৈব যৌগ বলে। যেমন-
জেনে রাখো : সকল জৈব যৌগই কার্বনের যৌগ কিন্তু সকল কার্বনের যৌগ জৈব যৌগ নয়।
জৈব যৌগ মাত্রই কার্বন যৌগ। তাই সংক্ষেপে কার্বনের রসায়নকে জৈব রসায়ন বলে। পুরনো মতবাদ অনুযায়ী- রসায়নের যে শাখায় সজীব অরগান (living organisms) তথা জীবদেহ থেকে প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত রাসায়নিক বস্তুর রসায়নকে জৈব রসায়ন।
জৈব ও অজৈব যৌগের মধ্যে পার্থক্য :
যৌগের বৈশিষ্ট্য (Properties of Organic Compounds):
১। কার্বন ও হাইড্রোজেন পরমাণু পরস্পরের সাথে অত্যন্ত শক্তিশালী সমযোজী বন্ধন দ্বারা যুক্ত থকে। এ অনেক অজৈব যৌগ রয়েছে যারা কার্বন ও হাইড্রোজেন দ্বারা তৈরি কিন্তু তাদের বন্ধনটি দুর্বল। তাই ঐ
জৈব যৌগের অন্তর্ভুক্ত নয়।
যেমন: হাইড্রোজেন সায়ানাইড (HCN) অজৈব যৌগ কিন্তু ইথেন নাইট্রাইল (CH3–CN) একটি জৈব যৌগ।
২.যৌগে একটি তাৎপর্যপূর্ণ সংখ্যক কার্বন ও হাউড্রোজেন পরমাণু রয়েছে যাদের সংখ্যা একটি নির্দিষ্ট যৌগ নির্দিষ্ট সংখ্যক কার্বন পরমাণু থাকবে ।
৩. জৈব যৌগে কার্বন-কার্বন সিগমা বন্ধনে অথবা কার্বন-হাইড্রোজেন সিগমা বন্ধন থাকবে ।
৪. অধিকাংশ জৈব যৌগ জীব দৈহের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে ।
৫. সব যৌগের ধর্ম এতটাই বৈচিত্র্যময় যে তাদেরকে ধর্মের উপর ভিত্তি করে ভিন্ন ভিন্ন সমগোত্রীয় শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়।
৬.অধিকাংশ হাইড্রোকার্বন জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় । কারণ এদের দহনে প্রচুর তাপ শক্তি নির্গত হয় ।
৭. জৈব যৌগে নির্দিষ্ট সংখ্যক পরমাণু বা পরমাণুগুচ্ছ ঐ যৌগের ধর্মাবলি নিয়ন্ত্রণ করে তাই ঐ পরমাণু বা পরমাণুগুচ্ছকে কার্যকরী মূলক বলা হয় । কার্যকরীমূলকের উপর ভিত্তি করে জৈব যৌগসমূহকে শ্রেণিবিন্যাস করা হয় ।
৮. জৈব যৌগের আকার বা ভর একাধিক যৌগের ধর্মে পার্থক্য সৃষ্টি করে ।
৯. জৈব যৌগগুলোর পরমাণুর সংখ্যা অনুরূপ হলেও তারা ভিন্ন গঠনের ভিন্ন ধর্মের যৌগ সৃষ্টি করে । তাই ধর্মকে সমানুতা বলে।
১০. জৈব যৌগগুলোর পলিমার তৈরি করে। বিশালাকার দৈত্যকার অণু তৈরি করার সক্ষমতা রয়েছে। ১১.জৈব যৌগগুলো তাৎপর্যপূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারে ।
জৈব যৌগের সংখ্যা (Number of Organic Compounds)
বর্তমানে জৈব যৌজের সংখ্যা প্রায় এক কোটিরও বেশি । এত অধীক সংখ্যাক জৈব যৌগের কারণ কি? বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে এই গঠনাটি ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের মতে জৈব যৌগের সংখ্যা অধীক হওয়ার কারণ ৬টি যথা:
(ক) কার্বনের ক্যাটিনেশন ধর্ম বিদ্যমান
(খ) কার্বনের যোজনী চার
(গ) কার্বনের সংকরায়ন বৈচিত্র্যপূর্ণ
(ঘ) জৈব যৌগের সমাণুতা প্রদর্শন
(ঙ) কার্বনের তড়িৎঋণাত্মকতা 2.5
(চ) পলিমার যৌগ গঠন।
(ক) কার্বনের ক্যাটিনেশন :
কাটিনেশন : Catenation শব্দটি ল্যটিন শব্দ Catena হতে এসেছে। এর অর্থ শিকল বা চেইন। অথাৎ অসংখ্য অনুরূপ মৌল পরস্পর সংযুক্ত হয়ে বিভিন্ন আকারের শিকল বা চেইন গঠন করার ধর্মকে ক্যাটিনেশন বলা। অসংখ্য কার্বন পমাণু পরস্পরের সাথে যুক্ত হয়ে দুই, তিন চার বা ততোধিক কার্বন পরমাণু সম্বলিত যৌগ গঠন তে পারে। তাই কার্বন দ্বারা গঠিত জৈব যৌগের সংখ্যা অতাধিক।
যেমন:
দুই কার্বন বিশিষ্টি ইথেন (CH3-CH3)
তিন কার্বন বিশিষ্ট প্রোপেন (CH3-CH2-CH3)
চার কার্বন বিশিষ্ট বিউটেন (CH3–CH2-CH2–CH3) ইত্যাদি।
কার্বন -কার্বন বন্ধন অত্যধিক শক্তিশালী। এর বন্ধন বিয়োজন এনথালপি 346 kjmole–1। তাই কার্বন-কার্বন, অত্যধিক স্থিতিশীল । এই কারনেই কার্বন পরমাণুতে ক্যাটিনেশন ধর্ম প্রবল।
(খ) কার্বনের যোজনী চার : কার্বনের যোজনী চার। কারণ উত্তেজিত অবস্থায় কার্বনের 2s অর্বিটালত ইলেকট্রন 2pz অর্বিটালে গমন করে। ফলে কার্বনের চারটি অযুগ ইলেকট্রনধারী চারটি অর্বিটালে তৈরি হয়। এ অবিটাল চারটি বন্ধন তৈরি করে।
C = 1s2 2s2 2px 2pz 2py
উত্তেজিত অবস্থায়,
C* = 1s2 2s2 2px1 2pz1 2py1
এই কার্বনের কার্বন তার সাথে আরও চারটি কার্বন পরমাণু সিগমা বন্ধনের সাহায্যে সংযুক্ত করে। এভাবে ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যক কার্বন ভিন্ন ভিন্ন যৌগ গঠন করতে পারে ।
(গ) কার্বন পরমাণুর সংকরায়ন: কার্বন পরমাণু যৌগ গঠনকালে তার প্রয়োজন সাপেক্ষে sp3 বা sp2 বা sp সংকরায়ন দ্বারা যথাক্রমে একক বন্ধন বা দ্বি-বন্ধন বা ত্রি-বন্ধন তৈরি করতে পারে ।
কার্বন sp2 সংকরায়ন দ্বারা তার ক্যাটিনেশন ধর্ম ব্যবহার করে ষাট কার্বন বিশিষ্ট ফুলারিন তৈরি করে।
(ঘ) জৈব যৌগের সমাণুতা: অনুরূপ আণবিক সংকেত বিশিষ্ট কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের এবং গঠনের যে সকল সকল যৌগ তৈরি হয় তাদের কে সমানু বলে। জৈব যৌগসমূহ সমাণুতা প্রদর্শন করার কারনে জৈব যৌগের সংখ্যা এত বেশি ।
যেমন: C3H6O যৌগটি দ্বারা নিজের যৌগগুলো তৈরি হয়
কার্বনের তড়িৎঋণাত্মকতা 2.5 : কার্বনের তড়িৎঋণাত্মকতা বিশুদ্ব সমযোজী বন্ধন তৈরি করতে পারে আবার হ্যালোজেনের সাথেও অনুরূপ বন্ধন তৈরি করতে পরে ।
যেমন :
(চ) জৈব যৌগগুলোর পলিমার তৈরি : অসংখ্য অনুরূপ বা ভিন্নরূপে অণু পরপস্পর ঘনীভূত হয়ে বা সংযুক্ত হয়ে যে বিশাল দৈত্যকার অণু তৈরি করে তাকে পলিমার বলে। জৈব যৌগসমূহ পলিমার তৈরি করতে সক্ষম হওয়ায় এদের সংখ্যা অত্যধিক।
যেমন : ইথিনের অসংখ্য অণু পরস্পর সংযুক্ত হয়ে পলিথিন তৈরি করে ।
উপরোক্ত ঘটনাগুলো জৈব যৌগের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়, তাই জৈব যৌগের সংখ্যা অত্যাধিক।