সিমেন্ট কি ?
সিমেন্টের সজ্ঞা: সিলিকা,অ্যালুমিনা ও আয়রন অক্সাইডের মিশ্রণকে উচ্চ তাপে উত্তপ্ত করলে যে চূর্ণাকার পদার্থ পাওয়া যায়, যা পানির উপস্থিতিতে বাসায়নিক প্রক্রিয়ায় জমাট বেঁধে পাথরের ন্যায় কঠিন পদার্থে পরিণত হয় তাকেই সিমেন্ট বলে।
বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের সিমেন্ট উৎপাদিত হয়। যেমন:- র্পোটল্যান্ড সিমেন্ট, পজুয়ালানা সিমেন্ট, ক্যালসিয়াম অ্যালুমিনেট সিমেন্ট এবং ক্ষকারোধী সিমেন্ট । এ সবল সিমেন্ট গুলোর মধ্যে র্পোটল্যান্ড সিমেন্ট অধিক ব্যবহৃত হয়। তাই র্পোটল্যান্ড সিমেন্টের প্রস্তুতি আলোচনা করা হল।
র্পোটল্যান্ড সিমেন্ট : বিভিন্ন সংযুতির ক্যালসিয়াম অ্যালুমিনেট ও ক্যালসিয়াম সিলিকের মিহি চূর্ণ মিশ্রণ যা পানের উপস্থিতিতে জমাট দৃঢ় ও শক্ত কর্ঠিন পদার্থে পরিণত হয় তাকে র্পোটল্যান্ড সিমেন্ট বলে।
গুরুত্ব পূর্ণ তথ্য:
ভালে সিমেন্ট প্রস্তুতির জন্য নিচের অনুপাত অনুসরণ করা হয়।
পোটল্যান্ড সিমেন্টের সংযুতি বৈশিষ্ট্য:
(i) আয়রন মুক্ত সিমেন্ট সাদা হয়, কিন্তু উপাদান মিশ্রণের তাপ জারণ দেরি হয়।
(ii) চুন কম থাকলে সিমেন্ট তারাতাড়ি জমাট বাধে; কিন্তু শক্ত কম থাকে। আবার চুনের শতকরা পরিমাণ (1.9-2.1) এর বেশি হলে সিমেন্টে ফাটল সৃষ্টি হয়।
(iii) সিলিকার অনুপাত কম হলে সিমেন্ট ধীরে ধীরে জমাট বাঁধে।
(iv) অ্যালুমিনার শতকরা পরিমাণ বেশি হলে সিমেন্ট খুব তারাতারি জমাট বাঁধে।
সিমেন্ট প্রস্তুতির কাঁচামাল:
পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট প্রস্তুতিতে দু’ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়।
ক. ক্যালকেরিয়াস দ্রব্য:ক্যালসিয়া যুক্ত যৌগ যেমন: চুন বা লাইম, চুনাপাথর এবং মার্বেল ইত্যাদি।
খ. আরজেলেসিয়াস: সিলিকা প্রধান যৌগ, যেমন: সিলিকা(SiO2), অ্যালুমিনা (Al2O3), চায়না ক্লে এবং আয়রন অক্সাইড(Fe2O3) ইত্যাদি।
এছাড়াও ক্লিংকারের সাথে সামান্য পরিমাণে জিপসাম ব্যাবহার করা হয়।
সিমেন্ট প্রস্তুত প্রণালি:
পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট প্রস্তুতি তিন ধাপে ঘটে – ১ম ধাপ-কাঁচামাল প্রস্তুতি: পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল দুটি পদ্ধতিতে প্রস্তুত করা হয়।
ক) সিক্ত পদ্ধতি: ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ কাঁচামালকে প্রথমে আবর্তক চূর্ণক ও পরবর্তী ধাপে বল মিলের সহায়তায় মিহি চূর্ণে পরিণত করে প্রাপ্ত চূর্ণকে ওয়াস মিলে যন্ত্রে পানি দ্বারা ধৌত করে সিক্ত উপাদানের সাথে নির্দিষ্ট অনুপাতে অন্যান্য কাঁচামাল যোগ করে স্লারি (Slurry) উৎপন্ন করা হয় এবং নির্দিষ্ট ট্যাঙ্কে জমা রাখা হয়।
খ) শুষ্ক পদ্ধতি: পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট প্রস্তুতিতে ব্যবহৃত প্রধান দু কাঁচামাল – ক্যালকেরিয়াস ও আরজেলেসিয়াস জাতীয় পদার্থকে সংগ্রহ করে পৃথক পৃথকভাবে প্রথমে আবর্তক চূর্ণক ও পরে বল মিলের সাহায্যে চূর্ণীভূত করা হয়। এরূপে প্রাপ্ত মিহিচর্ণকে মিশ্রণকারী যন্ত্রের সাহায্যে নির্দিষ্ট অনুপাতে মিশিয়ে ‘র মিল’ নামক সমসত্ব মিশ্রণ তৈরী করে নির্দিষ্ট ট্যাংকে জমা রাখা হয়।
২য় ধাপ – ভস্মীকরণ: সিক্ত অথবা শুষ্ক পদ্ধতিতে প্রস্তুতকৃত কাঁচামালের মিশ্রণকে একটি স্টিল নির্মিত ঘূর্ণায়মান চুল্লির [60 – 90m দীর্ঘ ও 6m প্রশস্ত] এর উপরিভাগে প্রবেশ করারনো হয়। চুল্লির নিম্নভাগ দিয়ে প্রবিষ্ট জ্বালানি কাঁচামাল মিশ্রণকে ভস্মীভূত করে ক্লিংকার তৈরী করে। ঘূর্ণায়মান চুল্লির উপরিভাগে 750 – 850°C, চুল্লির মধ্যাংশে 1100°C এবং নিম্নভাগে 1400 – 1500°C তাপমাত্রা থাকে। চুল্লিটি কিছুটা হেলানো থাকে যাতে উপরিভাগে প্রবেশকৃত উপাদানের ভস্মীভূত অংশ নিম্নভাগ থেকে সংগ্রহ করা যায়।
ঘূর্ণায়মান চুল্লিতে সংঘটিত বিক্রিয়াসমূহ:
ক) চুল্লির উর্ধ্বভাগে: 800°C তাপমাত্রায় মিশ্রনের সমস্ত পানির বাষ্পীভবন।
খ) চুল্লির মধ্যাংশ: 1100°C তাপমাত্রায় চুনাপাথরের বিয়োজিত হয়ে CaO (লাইম) ও CO2 উৎপন্ন করে।
গ) চুল্লির নিম্নভাগে : অতি উচ্চ তাপমাত্রায় (1500°C) লাইম ও ক্লে পরষ্পর বিক্রিয়া করে ডাইক্যালসিয়াম সিলিকেট [C2S (25%) ; 2CaO.SiO2], ট্রাইক্যালসিয়াম সিলিকেট [C3S (50%) ; 3CaO.SiO2], ডাইক্যালসিয়াম অ্যালুমিনেট [C2A (সামান্য) ; 2CaO.Al2O3],ট্রাইক্যালসিয়াম অ্যালুমিনেট [C3A (10%) ; 3CaO.Al2O3], টেট্রাক্যালসিয়াম অ্যালুমিনে ফেরাইট [C4AF (10%) ; 4CaO.Al2O3. Fe2O3] উৎপন্ন করে। এই উচ্চ তাপমাত্রায় পদার্থ গুলো গলে ক্ষুদ্র আকারের শক্ত পাথরের ন্যায় ধূসর বর্ণের ক্লিংকার তৈরী করে।
3CaO + SiO2 → 3CaO. SiO2
2CaO + Al2O3 → 2CaO. Al2O3
3CaO + Al2O3 → 3 CaO. Al2O3
3CaO + Al2O3 + Fe2O3 → 4CaO.Al2O3. Fe2O3
৩য় ধাপ – চূর্ণীকরণ : প্রাপ্ত ক্লিংকারকে শীতক যন্ত্রের সাহায্যে শীতল করে বল মিলে চূর্ণ করা হয়। প্রাপ্ত চূর্ণের সাথে 2 – 3% জিপসাম মিশ্রিত করলে ক্যালসিয়াম সালফো অ্যালুমিনেট (3CaO. Al2O3. 3CaSO4.2H2O) তৈরী হয়। যার ফলে সিমেন্ট দ্রুত জমাটবদ্ধ হয় না।
3CaO. Al2O3 + 3(CaSO4. 2H2O) + 2H2O → 3CaO. Al2O3. 3CaSO4.2H2O + 6H2O
প্রাবাহ চিত্র:
সিমেন্ট শিল্পের দূষক সমূহের ক্ষতিকর প্রভাব :
সিমেন্ট কারখানায় ক্লিংকার তৈরির সময় ঘূর্ণমান চুল্লিতে প্রচুর কয়লা ও প্রকৃতিক গ্যাস দহনের ফলে, চুল্লির বর্জ গ্যাসে SO2, CO2 CO এবং NOX মিশ্রিত থাকে । এসব মিশ্রিত গ্যাস বায়ু দূষিত করে। ফলে মানুষের ফুসফুস ও শ্বাস নালীর ক্ষতি হয়। এছাড়া সালফার ও নাইট্রোজেনের অম্লধর্মী অক্সাইড সমূহ(SO2 এবং NOX) বাতাসের জলীয় বাষ্পের সাথে ও অক্সিজেনের সাথে বিক্রিয়া করে যথাক্রমে HNO3 এবং H2SO4 উৎপন্ন করে যা বৃষ্টির সাথে মিশে এসিড বৃষ্টি সৃষ্টি করে। এর ফলে মটির PH কমে গিয়ে মটির উর্বতা হারায় এবং গাছ-পালা বিনষ্ট হয়।
লাইমস্টোন ও ক্লে মিনারেল কে উচ্চ তাপমাত্রায় উত্তাপকালে এগুলোর মধ্যে বিদ্যমান অপদ্রব্য থ্যালিয়াম, ক্যাডমিয়াম এবং মারকার্রী ইত্যাদি বিষাক্ত ধাতুর বাষ্প নির্গত হয়ে বায়ু দূষণ করে। এছাড়াও ক্লিংকার পদার্থের মধ্যেও নিকেল, জিংক এবং লেড ইত্যাতির মতো হেভি মেটাল বিদ্যমান। প্রসেসিং এর সময় ক্লিংকার পদার্থের সাথে চূর্ণিত পাউডার থেকে এসব ধাতু বায়ুতে নির্গত হয়ে বায়ু দূষণ করে ।
গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা মূলক প্রশ্ন :
সিমেন্ট প্রস্তুতির সময় 2 – 3% জিপসামের ব্যাবহার করা হয় কেন?
সিমেন্টের উপাদান ট্রাইক্যালসিয়াম অ্যালুমিনেট (3CaO. Al2O3) সিমেন্ট দ্রুত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে এবং দ্রুত জমাট বাঁধা অংশ পরে ফেটে যায়। কিন্তু জিপসাম (CaSO4.2HO) ট্রাইক্যালসিয়াম অ্যালুমিনেটের(3CaO. Al2O3) সাথে অদ্রবণীয় ক্যালসিয়াম সালফো অ্যালুমিনেট (3CaO. Al2O3. 3CaSO4.2H2O) তৈরি করে। ফলে সিমেন্টের দ্রুত জমাট বাঁধা প্রক্রিয়াটি ধীরে চলে এবং উৎপন্ন কঠিন পদার্থের দৃঢ়তা শক্তি বেড়ে যায়, ফেটে যায় না। সুতরাং সিমেন্টের জমাট বাঁধা প্রক্রিয়াকে মন্থর করা জিপসামের কাজ ।
3CaO. Al2O3 + 3(CaSO4. 2H2O) + 2H2O → 3CaO. Al2O3. 3CaSO4.2H2O + 6H2O
পোর্টল্যান্ড সিমেন্টকে হাইড্রোলিক সিমেন্ট বলা হয় কেন?
যে সকল সিমেন্ট পানির উপস্থিতিতে জমাট বাঁধতে পারে তাদেরকে হাইড্রোলিক সিমেন্ট বলে। পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট পানির উপস্থিতিতে বিক্রিয়া করে ধীরে ধীরে জমাট বাঁধতে শুরু করে এবং শেষ পর্যায়ে একটি কঠিন দৃঢ় বস্তুতে পরিণত হয়। এ ঘটনাকে সিমেন্টের জমাট বাঁধা বলা হয়ে থাকে। সিমেন্টের মধ্যে পরিমাণ মতো পানি যোগ করলে, সিমেন্ট উপস্থিত ক্যালসিয়াম যৌগগুলো বিয়োজিত হয়ে ক্যালসিয়াম হাইড্রক্সাইড এবং পানি সংযোজিত ক্যালসিয়াম সিলিকেট ও ক্যালসিয়াম অ্যালুমিনেটের কেলাস সৃষ্টি করে। এ কেলাসগুলো ধীরে ধীরে একটি অপরটির মধ্যে প্রবেশ করে একটি বিরাট সুদৃঢ় জালকের সৃষ্টি করে এবং দৃঢ়ভাবে জমাট বাঁধে। যেহেতু পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট পানির উপস্থিতিতে জমাট বাঁধে। তাই পোর্টল্যান্ড সিমেন্টকে হাইড্রোলিক সিমেন্ট বলা হয়।