চামড়া ট্যানিং :

চামড়া:- যে সকল প্রাণীর ত্বক প্রক্রিয়াজাতকরেনের পর সেটি নমনীয়তা বা প্রসারনশীলতা,স্থিতিশীলতা এবং পানি নিরোধক বৈশিষ্ট অর্জন করে তাদের চামড়া বলে।

ট্যানিং:- চামড়াকে রোগ জীবাণু মুক্ত করে, চামড়ার গুণাবলি অক্ষুন্ন রেখে, চামড়াকে পাকা করে দীর্ঘদিন ব্যাবহার উপযোগী করে তোলার পদ্ধতিকে ট্যানিং বলে।

ট্যনিং কয়েকটি পদ্ধতিতে করা হয় তনমধ্যে-

১. ভেজিটেবল ট্যানিং এবং ২. ক্রোম ট্যানিং নিয়ে আলোচনা করা হয়।

১. ভেজিটেবল ট্যানিং: কতিপয় উদ্ভিদের নির্যাস থেকে প্রাপ্ত ট্যানিং বিজারক (যেমন: ট্যানিক এসিড) দ্বারা কাঁচা চামড়া বিশেষ প্রকিয়ায় পাকা চামড়ায় পরিণত করার প্রক্রিয়াকে ভেজিটেবল ট্যানিং বলে।

মূলনীতি:-

কতিপয় উদ্ভিদের ছাল, পাতা, ফল এবং মূল ইত্যাদিকে ভালোমত পিষে কয়েকদিন পানিতে ভিজিয়ে রাখলে এর থেকে ট্যানিং পদার্থ নিঃসরিত হয়ে দ্রবণে চলে আসে। ট্যনিং পদার্থ মূলত ট্যানিন, ট্যানিক এসিড এবং পলিফেনল গ্লূকোসাইডের মিশ্রন।

উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত ট্যানিং পর্দার্থের দ্রবণে পশুর কাঁচা চামড়া কয়েকদিন ভিজিয়ে রাখলে ট্যানিক এসিড পশুর কাঁচা চামড়ার কোলজেন প্রোটিনের সাথে বিক্রিয়া করে পাকা লেদার তৈরি করে।

পশুর কাঁচা চামড়া + ট্যানিক এসিড = পাকা লেদার

ট্যানিন পদার্থের প্রধান উৎস সাধারণত গাছ-পালা তথা উদ্ভিদ বলে এ প্রক্রিয়াকে উদ্ভিজ্জ ট্যানিং বা ভেজিটেবল ট্যানিং বলে।

উদ্ভিজ্জ ট্যানিং বা ভেজিটেবল ট্যানিং একদিকে সময় সাপেক্ষ এবং অন্যদিকে ট্যানিন (গাছের কষ) সংগ্রহের জন্য উদ্ভিদ জগত ধ্বংস হয় বলে এ পদ্ধতি এখন আর ব্যবহৃত হয় না।

২. ক্রোম ট্যানিং :-

মূলনীতি:- এ প্রক্রিয়ায় কাঁচা চামড়াকে সরাসরি ট্যানিং করা যায়না। চামড়াকে ট্যানিং করার পূর্বে এনে ট্যানিং এর উপযোগী করতে হয়। এজন্য যে সব পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় তাকে প্রি-ট্যানিং ধাপ বলে। প্রি-ট্যানিং ধাপ চারটি পর্যায়ে সম্পন্ন করা হয় যথা: (১) সোকিং, (২) পশম অপসারন, (৩) বেটিং এবং (৪) পিকলিং।

১. সোকিং : এ ধপে পানির সাহায্যে চামড়ার সাথে যুক্ত লবণ, ধুলাবালি, রক্ত, অন্যান্য ময়লা, কাঁদামাটি এবং দ্রবনীয় প্রোটিন অপসারন করা হয়।

২. পশম অপসারন : চামড়াকে অতিরিক্ত চুনের দ্রবণের মধ্যে ডুবানো হলে চামড়ার কোলাজেন প্রোটিনের পেপটাইড বন্ধনের ক্ষারীয় আর্দ্রবিশ্লেষণ ঘটে। ফলে কোলাজেন প্রোটিন শিকলের এক প্রান্ত –+NH3 মূলক ও অন্য প্রান্তে -COO মূলকের সৃষ্টি হয়। লোম বা চুলের দুঢ়তার মূল কারন হলো সিস্টিন নামক অ্যামাইনো এসিডের মাধ্যমে আন্তঃপ্রোটন শিকলে ডাইসালফেড (S-S) বন্ধন সৃষ্টি। এতে যদি শার্পেনিং এজেন্ট (Na2S, NaCN এবং জৈব অ্যামিন সমূহ) যোগ করা হয় তাহলে এই ডাইসালফেড (S-S) বন্ধন ভেঙ্গে যায়। ফলে পশমসহ ,চর্বি, গ্রিজ ও কেরোটিনাস ইত্যাদি পদার্থ অপসারিত হয়।

৩.বেটিং : বেটিং করার জন্য চামড়াকে NH4Cl দ্রবণে ডুবিয়ে এর মধ্যে পেনক্সিয়েটিক এনজাইম যোগ করা হয়। ফলে চামড়ার সাথে যুক্ত অতিরিক্ত চুন ও কোলাজেন প্রোটিন ছাড়া অন্যান্য সব ধরনের প্রোটিনই অপসারিত হয়।

৪. পিকলিং : পিকলিং করার জন্য চামড়াকে 0.05 M H2SO4 দ্রবণ ও 1 M NaCl দ্রবণের মিশ্রণের মধ্যে ডুবিয়ে রাখা হয়। ফলে চামড়ায় যুক্ত Ca লবণসমূহ অপসারিত হয়। প্রোটিনের Ca লবণ এসিডের সাথে বিক্রিয়া করে Ca2+ সালফেট গঠন করে অপসারিত হয় এবং প্রোটিনের মধ্য লিংকেজ সৃষ্টি করে। অর্থাৎ চামড়াকে ক্রোম ট্যানিং এর  উপযোগী করে তোলে ।

পিকলিং ধাপ অতিক্রম না করা পর্যন্ত চামড়াকে ক্রোমো ট্যানিং করা যায় না।

চামড়ার টেনিং : চামড়াকে পাকা করে দীর্ঘদিন আমাদের প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করার জন্য চামড়ার ট্যানিং করা। হয়। পিকলিং প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পর চামড়াকে ট্যানিং করা হয়ে থাকে। ট্যানিং প্রক্রিয়া বেশ কয়েকটি পদ্ধতিতে সম্পন্ন করা যায়। তবে ক্রোম ট্যানিং আধুনিক পদ্ধতি।

মূলনীতি : ক্ষারকীয় ক্রোমিয়াম সালফেট [Cr2(SO4)3] বা ক্রোমিক [H2Cr2O7] এসিডের দ্রবণে চামড়াকে ভিজিয়ে রাখলে চামড়ার মধ্যস্থিত কোলাজেন প্রোটিনের দুটি গ্রূপ অ্যামিন গ্রূপ(-NH2) ও কার্বক্সিলিক গ্রূপ (-COOH) Cr- এর সাথে যুক্ত হয়ে কোলাজেন ক্রোমিয়াম জটিল যৌগ উৎপন্ন করে।

ক্রোমিয়াম দুটি প্রোটিন চেইনের মধ্যে একটি শক্তিশালী  ব্রিজ লিংক তৈরি করে থাকে। এভাবে বহু সংখ্যক Cr জটিল একে অপরের সাথে অক্সিজেনের মাধ্যমে যুক্ত হয়ে বৃহত্তর ব্রিজ গঠন করে থাকে। ফলে পিকলিং ধাপে প্রোটিনের মধ্যে সৃষ্ট লিংকেজগুলোকে পূর্ণ করে দেয়।

 

কার্যপ্রণালি : সাধারণত দুটি পদ্ধতিতে ক্রোম টেনিং সম্পন্ন করা হয়ে থাকে। একটি টু-বাথ পদ্ধতি অপরটি ওয়ান -বাথ পদ্ধতি। বর্তমানে ওয়ান বাথ পদ্ধতিও নিষিদ্ধ, কারণ এক্ষেত্রে হেক্সাঅ্যাকুয়া ক্রোমিয়াম (III) সালফেট [Cr(HO)6]2(SO4)3] কে ব্যবহার করার কারণে পরিবেশ দূষণের মাত্রা অধিক হয়। এর মধ্যে টু-বাথ পদ্ধতি দ্রুত ও সহজ পদ্ধতি হওয়ায় অধিক প্রচলিত।

টুবাথ পদ্ধতি : বেটিং ও পিকলিং করা চামড়াকে একটি প্যাডেলের মধ্যে নেওয়া হয়। এখানে চামড়ার ওজনের উপর ভিত্তি করে Cr এর যৌগ ও H2SO4 কে মিশ্রিত করা হয়। সাধারণভাবে এক পাউন্ড ওজনের চামড়ার সাথে 5 পাউন্ড ওজনের Na2Cr2O7 (5 – 6%) এবং H2SO4 (33%) মিশ্রণের 2.5 – 3% দ্রবণকে প্যাডেলে যোগ করা হয়। প্যাডেলকে ঘোড়ানো হয় এবং এখানে চামড়াকে প্রায় 3-5 ঘণ্টা রাখা হয়।

ফলে চামড়া ক্রোমিক এসিড শোষন  করে এবং চামড়ার উপর সর্বত্র হলুদ বর্ণ ধারণ করে। এ পর্যায়েই চামড়ার লিংকেজ Cr দ্বারা পূর্ণ হয়ে Cr মৌল চামড়ার ভিতরের প্রোটিনের সাথে বন্ড তৈরি করে জটিল Cr ট্যানিং চামড়া তৈরি করে থাকে।

চামড়াকে প্যাডেল হতে তুলে এনে অতিরিক্ত লিকারকে অপসারণ করা হয় এবং ক্রোম চামড়াকে ২য় প্যাডেলে নেওয়া হয়। এ প্যাডেলের মধ্যে Na2S2O3 (15 20%) ও HCl (33%) মিশ্রণের 6 – 10% দ্রবণ থাকে। এখানেও চামড়াকে নাড়াচাড়া করা হয়। ফলে চামড়ার হলুদ বর্ণ পরিবর্তিত হয়। সম্পূর্ণভাবে হলুদ বর্ণ দূরীভূত না হওয়া পর্যন্ত প্যাডেলের দ্রবণের মধ্যে ধীরে ধীরে HCl যোগ করা হয়। এ রুপ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে প্রায় 24-48 ঘণ্টা সময় লাগে ।

Na2Cr2O7  +  6 HCl  +  2 Na2S2O3 → 6 NaCl + 2 Cr(OH)SO4 + 2S + 2H2O

পরিশেষে চামড়াকে প্যাডেল থেকে উঠিয়ে একে গ্লূকোজের দ্রবণে ডুবানো হয়। এতে হলুদ বর্ণের ক্রোম রং সম্পূর্ণরুপে দ্রবীভূত হয়। অতঃপর একে গ্লূকোজের  দ্রবণ খেকে উঠিয়ে শুকালে ক্রোম লেদার পাওয়া য়ায়।

4 Na2Cr2O7 + 12 H2SO4 + C6H12O6  →  4Na2SO4 + 12H2O + 8 Cr(OH)SO4 + 6CO2

প্রবাহ চিত্র:

চামড়া শিল্পের দূষকের বর্ণনা :

১. চামড়া প্রসেসিং প্রক্রিয়ায় নির্গত ধূলা-বালি, গোবর, রক্ত, মাংস, দ্রবণীয় প্রোটিন এগুলো পঁচে প্রচুর দূর্গন্ধ সৃষ্টি করে, বায়ু দূষণ ঘটায় এবং বর্জে বিদ্যমান লবন (NaCl) ও রাসয়নিক পদার্থ মটি ও পানি দূষণ করে। ফলে মানুষের দেহ ও ত্বকে প্রদাহ, শ্বাসকষ্ট এবং জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ ক্ষতি গ্রস্থ হয়।

২. চামড়ার লোম অপসারণ প্রক্রিয়ায় ব্যাবহৃত চুন, সার্পেনিং এজেন্ট (Na2S এবং NaCN) এবং বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ থেকে উৎপন্ন সালফাইট আয়ন, ধাতব কণা এবং কঠিন কণা ইত্যাদি পানিকে দূষিত করে। ফলে এর মান BOD বৃদ্ধি পায় এবং DO এর পরিমাণ কমে যায়। এতে জলজ ইকো সিস্টেম সহ সমস্ত প্রণীকূল ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

৩. চুন অপসারণ প্রক্রিয়ায় ব্যাবহৃত অ্যামোনিয়াম লবণ [NH4Cl এবং (NH4)2SO4] থেকে নির্গত NH3, Clএবং SO42- পানি ও বায়ু দূষণ করে।

৪. ক্রোম ট্যানিং এ ব্যবহৃত Cr3+ আয়ন জারিত হয়ে Cr6+আয়নে রুপে খাদ্য শৃঙ্খলে ঢুকে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে। ফলে মানুষের যকৃত ও কিডনী বিকল হয়ে পড়ে, চর্ম রোগ, পাকস্থলির ঘা, ফুসফুসে ক্যান্সার, ব্রঙ্কাইটিস এবং গর্ভবতী মায়ের শিশু ও ভ্রূণের ক্ষতি হয়।

৫. বর্জ চামড়া থেকে প্রস্তুতকৃত  Poultry Food হাঁস-মুরগির খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হলে খাদ্যে ক্রোমিয়াম দূষণ ঘটে।

 

গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা মূলক প্রশ্ন

****ট্যানিং-এ Milk of lime কেন গুরুত্বপূর্ণ কেন ?

Milk of lime বলতে মূলত সোডিয়াম সালফাইড, সায়ানাইড, স্যামিন ইত্যাদি যুক্ত চুনের পানিকে [Ca(OH)] বুঝায়। ট্যানিং প্রক্রিয়ায় সোকিং  ধাপ এর পর লাইমিং করা আবশ্যক। লাইমিং ধাপে, milk of  lime মূলত নিম্নলিখিত কারণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ –

(i) এটি চামড়ার পশম, নখ ও ক্যারাটাইনাস জাতীয় পদার্থ দূরীভূত করে।

(ii) কিছু দ্রবীভূত প্রোটিন, যেমন—মিউসিনকে বিমুক্ত করে।

(iii) চামড়ার আঁশ বা ফাইবারকে ভালোভাবে আলাদা করে মসৃণতর করে।

(iv) গ্রিজ জাতীয় পদার্থ ও ফ্যাটকে কিছু পরিমাণ নির্গত করে।

(v) কোলাজেন তৈরির মাধ্যমে ট্যানিং কার্যকরী করে।

****চামড়ার ট্যানিং এ লবণ যুক্ত করা হয় কেন ?

চামড়া ট্যানিং এর সাহায্যে পশুর কাঁচা চামড়াকে ব্যবহার উপযোগী করে তোলা হয়। ট্যানিং-এর সময় চামড়াকে লবণযুক্ত করা হয় যাতে চামড়ায় বিদ্যমান প্রোটিন জাতীয় পদার্থ যেমন- কোলাজেন যাতে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা পঁচে না যায়। এছাড়া খাবার লবণ (NaCl) যোগ করার ফলে এটি কোলাজেনের pH মানকে বেশ নিচে নামিয়ে চামড়ায় খনিজ ট্যানিং পদার্থ প্রবেশে সাহায্য করে এবং চামড়ার pH নেমে গিয়ে যে ক্ষতি হতো তা নিয়ন্ত্রণে রাখে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!