ইটিপির কার্যপ্রণালীর (Working Proces Effluent Treatment)
কারখানার বর্জ্য পানি পরিশোধন (Industrial Waste water Treatment or Effluent Treatment) রসায়ন শিল্পে বিভিন্ন প্রকার প্রকৃতি ও রাসায়নিক দ্রব্য কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রকার প্রডাক্ট তৈরি করা হয় যা মানুষের এবং প্রাণীকুলের দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে কোন রাসায়নিক কারখানাতেই ব্যবহৃত কাঁচামাল সবটুকুই উৎপাদিত পণ্যে রূপান্তরিত হয়না। কিছু কিছু কাঁচামাল অথবা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন Intermedia Product or Re-product প্রসেসে থেকে যায়, যা পরবর্তীতে তরল/গ্যাস/কঠিন পদার্থ আকারে পরিবেশে মিশে যায় এবং পরিবেশকে দূষিত করে।
যে প্রক্রিয়ায় কারখানার বর্জ্য পানি পরিশোধন করা হয় তাকে Effluent Treatment Plant (ETP) বলে।
রাসায়নিক কারখানা হতে বিভিন্ন পদার্থ (জৈব ও অজৈব পদার্থ) মিশ্রিত রঙিন পানিকে নিয়ে উল্লেখিত উপায়ে পরিশোধন করা যায় ।
(১) রাসায়নিক প্রক্রিয়া (Chemical process)
(২) বালোলজিক্যাল প্রক্রিয়া (Biological process)
(৩) তড়িৎ বিশ্লেষণ প্রক্রিয়া (Electrolytic Process)
পরিশোধন প্রক্রিয়াকে তিনটি ধাপে বিভক্ত করা হয়। যথা:
(১) প্রাইমারী ট্রিটমেন্ট : এটা একটি ভৌত প্রসেস (Physical Process)। এখানে ছাঁকনির মাধ্যমে ভাসমান অপদ্রব্যগুলি দূর করা হয় এবং স্কিনিং বা ফ্লোটেশনের (Skining বা Floatation) মাধ্যমে বর্জ্য পানিতে মিশ্রিত তেল ও গ্রীজকে দূর করা হয় এবং কারখানার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন কোয়ালিটির পানিকে মিশ্রিত করে Uniform quality-এর পানি তৈরি করা হয়।
প্রাইমারী ট্রিটমেন্ট নিমলিখিত ধাপে ঘটে ।
(ক) মিশ্রিতকরণ (mixing all types of water)
(খ) ভাসমান পদার্থ পৃথকীকরণ (Separation of all floating materials)।
(গ) তৈল ও গ্রীজ অপসারণ।
(২) সেকেন্ডারী ট্রিটমেন্ট : রাসায়নিক ট্রিটমেন্ট (Coagulation → Floatation → Filtration → pH adjustiment → drain)
বালোজিক্যাল ট্রিটমেন্ট : Aerobic/Anaerobic condition-এ activated sludge ট্রিটমেন্ট করে পানিকে পরিশোধিত করা হয়।
তড়িৎ বিশ্লেষণ পদ্ধতি : এ পদ্ধতিতে একটি electrolytic cell ব্যবহার করা হয়, যার মাধ্যমে বর্জ্য পানিতে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হয়। ফলে পানিতে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক চার্জ প্রবাহিত হয়ে চার্জমুক্ত হয়ে পানিকে পরিশোধিত করে।
(৩) টারশিয়ারী ট্রিটমেন্ট (Tertiary Treatment) : এই প্রক্রিয়ায় নিমলিখিত উপায়ে পানি পরিশোধন করা হয়।
ক.জারণ (Chemical Oxidation)
খ. ক্লোরিনেশন (Chlorination)
গ. ওজোন পরিশোধন (Ozone treatment)
তড়িৎ বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে ইটিপি র কার্যপ্রণালীর মূলনীতি
পানিতে যদি উচ্চ ঘণমাত্রার আয়নিক দূষক(যেমন:NaCl, MgCl2, AlCl3 এবং FeCl2 ইত্যাদি ) বিদ্যমান থাকে তবে তড়িৎ বিশ্লেষণ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। তড়িৎ বিশ্লেষণ পদ্ধিততে একটি তড়িৎ ডায়ালাইজার ব্যাবহৃত হয়। ইহা একটি তড়িৎ রাসায়নিক কোষ বিশেষ। কোষের অভ্যন্তরে ক্যাথোড এবং অ্যানোড ছাড়াও ক্যাটায়ন প্রবাহিত হওয়ার জন্য দুইটি ঝিল্লি এবং অ্যানায়ন প্রবাহিত হওয়ার জন্য দুইটি ঝিল্লি স্থাপন করা হয় । তড়িৎ বিশ্লেষ্য হিসাবে আয়নযুক্ত দূষক (যেমন:NaCl, MgCl2, AlCl3 এবং FeCl2 ইত্যাদি) পানি ব্যবহৃত হয়। তড়িৎ কোষের উপর দিক দিয়ে দূষক পানি চালনা করা হয় এবং বাহ্যিক উৎসের সাহয্যে উহাদের মধ্যে দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হয়। এতে ক্যাটায়নিক দূষক (যেমন: Na+, Mg2+,Al3+ এবং Fe2+ ইত্যাদি ) ক্যাথোড কর্তৃক আকৃষ্ট হয় এবং ঝিল্লির মধ্য দিয়ে বাহিত হয়ে ক্যাথোডে গিয়ে চার্জমুক্ত হয়ে ধাতু (যেমন:Na, Mg, Al এবং Fe) হিসাবে জমা হয় । অপরদিকে অ্যানায়নিক দূষক (যেমন:Cl-) অ্যানোড কর্তৃক আকর্ষিত হয় ঝিল্লির মধ্য দিয়ে বাহিত হয়ে অ্যানোডে গিয়ে চার্জমুক্ত হয়ে Cl2 গ্যাস হিসাবে নির্গত হয়। এভাবে দূষক পানি বিশুদ্ধ হয় ।
উদাহরণ সরুপ NaCl কে আয়নিক দূষক ধরলে তড়িৎ ডায়ালাইজারে জারণ এবং বিজারণ বিক্রিয়া নিম্নরুপে হয়।
জারণ বিক্রিয়: 2Cl– – 2e– → Cl2
বিজারণ বিক্রিয়: Na+ + e– → Na
প্রভাবন পদ্ধতিতে ইটিপি’র কার্যপ্রণালীর মূলনীতি (Working Principle of ETP in Catalysis)
শিল্প কারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য পানি (effluent) পরিশোধনের জন্য প্রভাবন পদ্ধতি তেমন প্রচলিত নয়। এ পদ্ধতিটি অধক্ষেপণ পদ্ধতির একটি বিশেষ রূপ। প্রভাবন পদ্ধতিতে ইটিপি’র কার্যপ্রণালীর মূলনীতিকে দুভাগে ভাগ করা যায়।
১. তলায়ন (Sedimentation)
২. রাসায়নিক অধঃক্ষেপণ (Floculation)
১. তলায়ন (Sedimentation) : বর্জ্য পানি দীর্ঘ সময় স্থির অবস্থায় রেখে দিলে অধিকতর ভারী অপদ্রব্য অভিকর্ষ বলের প্রভাবে স্লাজ (sludge)তলানি হিসেবে নিচে জমা হয়। এ পদ্ধতি তলায়ন(Sedimentation) বলে ।
২. রাসায়নিক অধঃক্ষেপন (Floculation) : ফ্লোকিউলেশন একটি রাসায়নিক পদ্ধতি। অভিকর্ষ বলের প্রভাবে যে সকল অপদ্রব্যের তলানি পড়তে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। এ পদ্ধতিতে তলায়নের হার বৃদ্ধির জন্য ফ্লোকিউলেটিং এজেন্ট হিসেবে পটাশ এলাম বা ফিটকিরি(k2SO4, Al(SO4)2.24H2O), ফেরাস সালফেট (FeSO4) ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। এ সকল পদার্থের কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য কিছু সিলেকটিভ প্রভাবক ব্যবহৃত হয়। তাই এ পদ্ধতি প্রভাবন পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত । বর্জ্য পানিতে বিদ্যমান যে সকল অপদ্রব্য সাধারণত ধনাত্মক বা ঋণাত্মক চার্জবাহী, সেগুলো ফ্লোকিউলেটিং পদার্থের প্রভাবে (neutralize) হয়ে যায়। ফলে চার্জবিহীন অপদ্রব্যগুলো পরস্পরের সংস্পর্শে এলে আকারে বড় হতে থাকে এবং এক পর্যায়ে অধ:ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। অবশিষ্ট ধাতব আয়নসমূহ পানিযোজিত (hydrated) অক্সাইডে পরিণত হয়।
2Al3+ + 6OH– + (x – 3)H2O → Al2O3 + xH2O
2Fe3+ + 6OH + (x -3)H2O → Fe2O3 + xH2O
পানিযোজিত Al এবং Fe অক্সাইড পানিতে অদ্রবণীয় বলে এগুলো অধ:ক্ষিপ্ত হয় এবং পরিস্রাবণ করে এগুলোকে মুক্ত করা হয়।
জীব প্রযুক্তিতে ইটিপি’র কার্যপ্রণালীর মূলনীতি (Working Principle of ETP in Bio- Techonology)
প্রাথমিক পর্যায়ে প্রক্রিয়াকৃত তরল স্লাজ নিয়ে এ প্রক্রিয়া শুরু হয় । তরল সুজ (Sludge)-কে ফিল্টারের মাধ্যমে জৈন বর্জ্য পানি প্রক্রিয়াকরণ প্ল্যান্টে পাঠানো হয়। এ প্রক্রিয়ায় জৈব পদার্থসমূহ জীব বিশ্লেষিত হয়।
১. জীব বিশ্লেষিত তরল স্লাজকে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি জৈব ডেট্রিটাস জীব(ব্যাক্টেরিয়া, প্রোটোজোয়া, শামুক, কৃমি, কীটপতঙ্গ এবং ছত্রাক) যুক্ত পাত্রে ফোঁটায় ফোঁটায় যোগ করা হয়।
২. খাদ্য চেইন এ ব্যাক্টেরিয়া জৈব স্লাজকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।
৩. প্রোটোজোয়া ব্যাক্টেরিয়া ও ছত্রাককে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।
৪. আর শামুক ও পতঙ্গ প্রোটোজোয়া খেয়ে বেঁচেথাকে।
৫. ডেট্রিটাস জীব দ্বারা প্রক্রিয়াকৃত স্লাজকে স্টেলিং ট্যাংকে পাঠানো হয়। স্টেলিং ট্যাংক থেকে প্রাপ্ত স্লাজকে ডাইজেস্টারে এবং ড্রাইং বেডে পাঠানো হয়। অন্যদিকে প্রাপ্ত পানি ব্লিচিং-এর উদ্দেশ্যে ক্লোরিনেশন ট্যাংকে পাঠানো হয়। ক্লোরিনেশনের ফলে প্যারাফেনিক ব্যাক্টেরিয়া এবং প্রোটোজোয়া মারা যায়।
৬. ক্লোরিনেটেড পানিকে পাইপের মাধ্যমে পুকুরে এবং পুকুর থেকে নদী কিংবা সমুদ্রে ফেলা হয়।
৭. অপর দিকে ড্রাইং বেড থেকে প্রাপ্ত শুকনো স্লাজ নিচু জমি কিংবা কৃষি জমিতে ফেলা হয়।