আয়নিক যৌগের পানিতে দ্রবণীয়তা (Dissolution of Ionic Compounds in Water)
Like dissolves like এ নীতিতে বিভিন্ন যৌগ বিভিন্ন দ্রাবকে দ্রবীভূত হয়। এ নীতির অর্থ হলো আয়নিক যৌগ পোলার দ্রাবকে এবং সমযোজী যৌগ অপোলার দ্রাবকে দ্রবীভূত হয়। আয়নিক যৌগ অপোলার (non-polar) দ্রাবকে অদ্রবণীয় হয়। পোলার যৌগ বলতে এমন যৌগকে বোঝায় যার এক প্রান্তে আংশিক ধনাত্মক এবং অন্য প্রান্তে আংশিক ঋণাত্মক আধানের সৃষ্টি হয়, পানি এরূপ একটি পোলার দ্রাবক। তরল NH3, নাইট্রিক এসিড, তরল SO2, তরল HX এসিডসমূহ পোলার দ্রাবক । অপোলার দ্রাবকসমূহের মধ্যে কার্বন টেট্রাক্লোরাইড (CCl4), বেনজিন (C6H6), হেপ্টেন (C7H16), কেরোসিন, ডিজেল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
পোলার দ্রাবক পানিতে আয়নিক যৌগ যেমন: NaCl বা গ্রুপ-1 এর ধাতুর হ্যালাইডসমূহ কীভাবে দ্রবীভূত হয়
পোলার দ্রাবকের যেমন: পানি অণুর দুই প্রান্তে দুটি মেরু থাকে । আয়নিক যৌগের যেমন: NaCl এর ঘনকাকৃতির কেলাসকে দ্রবীভূত করার সময় পানির ঋণাত্মক মেরু NaCl এর ধনাত্মক আয়নের দিকে এবং পানির ধনাত্মক মেরু NaCl এর ঋণাত্মক আয়নের দিকে আবর্তিত হয় । ফলে NaCl এর Na+ আয়ন ও Cl– আয়নসমূহ পানি অণু দ্বারা আকর্ষিত হয় এবং কেলাস ল্যাটিস থেকে ক্রমশ দ্রবণে চলে আসে। Na+ ও Cl– আয়নসমূহ দ্রবণে পুরোপুরি মুক্ত থাকে না। তারা দ্রাবক পানি অণুর সাথে সংযোজিত থাকে (solvated)। NaCl এর ক্ষেত্রে প্রতিটি Na+ আয়ন ও Cl– আয়ন ছয়টি করে H2O এর সাথে সংযোজিত থাকে । সংযোজিত H2O এর সংখ্যা আয়নের আকারের ওপর নির্ভর করে। যেমন: Na+ (H2O)6, Cl–(H2O)6, F(H2O)4 ইত্যাদি। জলীয় দ্রবণে আয়নিক যৌগের আয়নসমূহের এরূপে পানি অণু সংযোজিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে পানি যোজন বা হাইড্রেশন (Hydration) বলা হয় । পানি-যোজন হলো একটি তাপোৎপাদী প্রক্রিয়া ।
হাইড্রেশন শক্তি (Hydration Energy) : প্রতি মোল পরিমাণ ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আয়নের সাথে পানি অণুর সংযোগের সময় নির্গত শক্তিকে হাইড্রেশন শক্তি বলে । এ নির্গত তাপ শক্তির প্রভাবে NaCl এর কেলাস-ল্যাটিস থেকে আয়নগুলো পৃথক হয়ে পানিতে দ্রবীভূত থাকে। হাইড্রেশন শক্তি সবসময় ঋণাত্মক হয়। Na+ আয়ন ও Cl– আয়নের হাইড্রেশন শক্তি যথাক্রমে – 406kJ mol-1 এবং – 363 kJ mol-1 |
Na+ + 6H2O → Na+.6 H2O ∆H = – 406kJ mol-1
Cl– + 6H2O → Cl–.6H2O ∆H = – 363 kJ mol-1
সবচেয়ে ছোট ধনাত্মক আয়ন Li+ এর হাইড্রেশন শক্তি হয় -520 kJ mol-1 এবং সবচেয়ে ছোট ঋণাত্মক আয়ন F– এর হাইড্রেশন শক্তি হয় – 524 kJ mol-1 ।

দ্রবণীয়তার শর্ত : সাধারণত আয়নিক যৌগের হাইড্রেশন শক্তি যখন এর ল্যাটিস-শক্তি বা কেলাস ল্যাটিস ভাঙার শক্তির চেয়ে বেশি হয়; তখন সহজে ঐ যৌগ পানিতে দ্রবীভূত হয়। যেমন-AgCl, AgBr, AgI, BaSO4, PbSO4 ইত্যাদির হাইড্রেশন শক্তি তাদের ল্যাটিস শক্তির চেয়ে অনেক কম। তাই এসব যৌগ কক্ষ তাপমাত্রায় পানিতে দ্রবণীয়। AgCl পানিতে অদ্রবণীয় কিন্তু AgF পানিতে দ্রবণীয়; এর কারণ ফ্লোরাইড আয়ন (F) এর আকার খুব ছোট হওয়ায় F– আয়নের পানি যোজন খুব ঘনিষ্ঠভাবে ঘটে । তাই F– আয়নের হাইড্রেশন শক্তি Cl– আয়নের চেয়ে বেশি হয়। ফলে Ag+ ও F– আয়নদ্বয়ের মোট হাইড্রেশন শক্তি তাদের কেলাস ল্যাটিস শক্তির চেয়ে বেশি হয় এবং AgF পানিতে দ্রবীভূত হয়। অপরদিকে AgCl এর হাইড্রেশন শক্তি এর ল্যাটিস শক্তির চেয়ে কম হওয়ায় AgCl পানিতে অদ্রবণীয় থাকে।
আবার PbCl2 ঠাণ্ডা পানিতে অদ্রবণীয়, কিন্তু গরম পানিতে দ্রবণীয়। এর কারণ PbCl2 এর হাইড্রেশন শক্তির চেয়ে ল্যাটিস্ শক্তি সামান্য বেশি। তাপ প্রয়োগ করলে ঐ তাপ শক্তি হাইড্রেশন শক্তির সহযোগীরূপে ল্যাটিস্ শক্তিকে অতিক্রম করে এবং উত্তপ্ত অবস্থায় PbCl2 গরম পানিতে দ্রবীভূত থাকে। তাই PbCl2 এর পানিতে দ্রবণীয়তা প্রক্রিয়া হলো প্রকৃত তাপশোষী। অনুরূপভাবে NaCl এর দ্রবণীয়তা মৃদু তাপশোষী হয়।
কেলাস ল্যাটিস (Crystal Latice) : সব আয়নিক যৌগ কেলাসাকার কঠিন পদার্থ হয়। কক্ষ তাপমাত্রায় কোনো আয়নিক যৌগ তরল বা গ্যাসীয় অবস্থায় থাকে না। কেলাস গঠনকালে সমধর্মী আয়নগুলো পরস্পরকে বিকর্ষণ এবং বিপরীতধর্মী আয়নগুলো পরস্পরকে আকর্ষণ করে স্থির বৈদ্যুতিক আকর্ষণ বল দ্বারা নির্দিষ্ট স্থানে ত্রিমাত্রিকভাবে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। উভয় প্রকার আয়নগুলোর কেন্দ্রবিন্দুগুলোকে কাল্পনিক রেখা দ্বারা যুক্ত করলে মৌমাছির মৌচাকের মতো যে জালিকা সৃষ্টি হয়, তাকে কেলাসের জালিকা বা কেলাস ল্যাটিস বলে। কেলাস জালিকা বিভিন্ন জ্যামিতিক আকৃতির হতে পারে।
ল্যাটিস শক্তি (Latice Energy) : আয়নিক যৌগের কেলাস গঠনকালে বিপরীত আধানযুক্ত ক্যাটায়ন ও অ্যানায়নগুলো স্থির বৈদ্যুতিক আকর্ষণ বলের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে সম্ভাব্য নিকটে আসে। ফলে এদের মধ্যেকার স্থিতিশক্তির মান অপেক্ষাকৃতভাবে হ্রাস পায়। যে পরিমাণ স্থিতি শক্তি হ্রাস পায়, ঠিক সমপরিমাণ শক্তি ঐ যৌগের কেলাস থেকে নির্গত হয় তাকে ঐ আয়নিক যৌগের কেলাস ল্যাটিস শক্তি বলে। যেমন:
Na+(g) + Cl+(g) → NaCl (s); ∆H = – 788 KJmol-1
NaCl এর ল্যাটিস শক্তি = – 788 KJmol-1 এবং NaCl এর ল্যাটিস ভাঙার শক্তি হবে = + 788 KJmol-1 উল্লেখ্য কেলাসে ল্যাটিস গঠন প্রক্রিয়া হলো তাপপাৎপাদী; তাই ল্যাটিস গঠন শক্তির মান ঋণাত্মক হয়। বিপরীতভাবে কেলাস ল্যাটিস ভাঙ্গার শক্তি হলো তাপশোষী প্রক্রিয়া; তাই এটির মান ধনাত্মক হয়। ল্যাটিস ভাঙ্গা প্রক্রিয়ায় শোষিত তাপ শক্তিকে ল্যাটিস এনথালপি বলে।
সংজ্ঞা : গ্যাসীয় অবস্থায় ক্যাটায়ন ও অ্যানায়ন থেকে এক মোল (mole) পরিমাণ আয়নিক যৌগের কেলাস গঠনকালে যে পরিমাণ শক্তি নির্গত বা মুক্ত হয়, তাকে ঐ আয়নিক যৌগের কেলাস ল্যাটিস শক্তি বলে । ল্যাটিস শক্তি হলো কেলাসের Poential energy। তাই কেলাস গঠনের সময় নির্গত শক্তির পরিমাণ যত বেশি হয়, ঐ আয়নিক কেলাস ততো বেশি সুদৃঢ় হয়।
ল্যাটিস শক্তির নির্ভরশীলতা :
(১) আয়নদ্বয়ের আধান : আয়নিক যৌগের আয়নদ্বয়ের আধান বা চার্জের পরিমাণ বৃদ্ধির সাথে কেলাসে ল্যাটিস শক্তির মানও বৃদ্ধি পায়। তখন আয়নিক বন্ধন শক্তি ও স্থায়িত্ব অধিক হয়।
(২) আয়নদ্বয়ের আকার : ধনাত্মক আয়ন ও ঋণাত্মক আয়নের আকার বৃদ্ধির সাথে ল্যাটিস শক্তির মান হ্রাস পায়। কারণ আয়নদ্বয়ের আকার বড় হলে কেলাস ল্যাটিস গঠনে উভয় আয়নের কেন্দ্রবিন্দুর অবস্থান দূরত্ব (d) বৃদ্ধি পায়। কুলম্বের সূত্র মতে, ল্যাটিস শক্তি, F = k(q1q2)/d2 এক্ষেত্রে ধ্রুবক k এর মান কেলাস গঠনে আয়নদ্বয়ের বিন্যাস প্রকৃতি নির্ভর করে বিভিন্ন হয়ে থাকে। উল্লেখ্য crystallography বা, কেলাস গঠনভিত্তিক গণনা হলো জটিল পরীক্ষা নির্ভর এ বিষয়টি (১) X-ray Crystallography, (২) Electron diffraction ও (৩) Neutron diffran (scattering) পদ্ধতিতে আলোচিত।
তবে ফাজানের নিয়ম মতে ধনাত্মক আয়নের আকর্ষণ দ্বারা ঋণাত্মক আয়নের ইলেকট্রন মেঘের অবস্থানের বিকৃতি বা পোলারায়ন ঘটলে তখন ল্যাটিস শক্তির মান ও স্থায়িত্ব হ্রাস পায়। ফলে যৌগে আয়নিক বৈশিষ্ট্য হ্রাস পায়, এবং বিপরীতভাবে সমযোজী ধৰ্ম বৃদ্ধি পায়। তখন ল্যাটিস শক্তির প্রভাব বা পোলারায়নের প্রভাব, এ দুয়ের মধ্যে কোনো একটির প্রভাব ঐ যৌগে প্রাধান্য পায়। গ্রুপ-1 এর ধাতুর ক্লোরাইড সমূহ LiCl এর বেলায় পোলারায়ন প্রভাব বেশি পড়ে এব অপর চারটি ধাতুর ক্লোরাইডে ল্যাটিস শক্তির প্রভাব বেশি থাকে। এদের মধ্যে থেকে তা বুঝা যায়। যেমন:

ফাজানের পোলারায়ন সূত্র মতে সমযোজী বৈশিষ্ট্য ক্রম : LiCl > NaCl> KCl > RbCl > CsCl
গ্রুপ-1 ধাতব ক্লোরাইড লবণগুলোর প্রকৃত গলনাঙ্ক ক্রম : NaCl > KCl > RbCl > CsCl > LiCl
*ফাজানের সূত্র মতে, LiCl এর গলনাঙ্ক হ্রাসের ব্যাখ্যা মিলে; কিন্তু অপর ক্লোরাইড লবণগুলোর বেলায় ফাজানের পোলারায়ন সূত্র মতে ক্রমটি অকার্যকর; কিন্তু ল্যাটিস শক্তি-ক্ৰম কার্যকর হয়েছে প্রমাণিত হয়।
ল্যাটিস শক্তির ব্যবহার :
(১) কোনো কেলাসের ল্যাটিস শক্তির মান জানা থাকলে তা থেকে কেলাসটি পোলার দ্রাবকে কীরূপ দ্রবীভূত হবে তা জানা যায় ।
(২) ল্যাটিস শক্তির তুলনায় হাইড্রেশন শক্তি যতো বেশি হবে, আয়নিক যৌগের পানিতে দ্রবণীয়তা ততো বেশি হবে।
(৩) ল্যাটিস শক্তি ও হাইড্রেশন শক্তি উভয়েই ক্যাটায়ন ও অ্যানায়নের চার্জ বা আধানের বৃদ্ধির সাথে বাড়ে এবং তাদের আকার বৃদ্ধির সাথে কমে।
(২) ধাতব হাইড্রক্সাইডসমূহের পানিতে দ্রবণীয়তা ল্যাটিস শক্তি ও হাইড্রেশন শক্তি থেকে ব্যাখ্যা করা যায়। যেমন গ্রুপ-2 এর ১ম ধাতু Be এর ছোট আকারের Be2+ আয়ন দ্বারা OH– আয়নের পোলারায়ন বেশি ঘটে; তাই Be(OH)2 পানিতে অদ্রবণীয়; কিন্তু পরবর্তী ধাতুসমূহের হাইড্রক্সাইড যেমন Mg(OH)2, Ca(OH)2 ইত্যাদি পানিতে দ্রবণীয় । কারণ এদের মধ্যে বড় আকারের Mg2+ ও Ca2+ আয়ন দ্বারা পোলারায়ন কম ঘটে।
এক্ষেত্রে অ্যানায়নের চার্জ ও আকার প্রতি ক্ষেত্রে সমান; কিন্তু ধনাত্মক আয়নের আকার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়। ফলে এদের ল্যাটিস শক্তি ও হাইড্রেশন শক্তি ক্রমাগত হ্রাস পায়। তবে হাইড্রেশন শক্তি অপেক্ষা ল্যাটিস শক্তি কিছুটা দ্রুততর হ্রাস পায়। তখন Be(OH)2 এর ক্ষেত্রে ল্যাটিস শক্তির পরিমাণ এর হাইড্রেশন শক্তির চেয়ে বেশি থাকে। এ কারণে Be(OH)2 পানিতে অদ্রবণীয়।
কিন্তু Mg2+ আয়ন থেকে পরবর্তী Ca2+, Sr2+, Ba2+ আয়নের আকার বৃদ্ধির সাথে এদের হাইড্রেশন শক্তি ল্যাটিস শক্তির চেয়ে বেশি হয়। ফলে এসব মৌলের হাইড্রক্সাইডের পানিতে দ্রাব্যতা ক্রমাগত বাড়ে। তাই Mg(OH)2, Ca(OH)2 পানিতে দ্রবণীয় । গ্রুপ-2 এর ধাতুর হাইড্রক্সাইডের পানিতে দ্রাব্যতা বৃদ্ধির ক্রম হলো :
Mg(OH) 2 < Ca(OH) 2 < Sr(OH) 2 < Ba(OH) 2