বিভিন্ন পদার্থের ভৌত অবস্থা তথা তার গলনাঙ্ক ও স্ফুটাঙ্কের মান অণু গঠনে সংশ্লিষ্ট বন্ধন এবং অণুসমূহের মধ্যে বিরাজিত আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বলের উপর নির্ভর করে। যেমন:

বিভিন্ন ব্যাখ্যা :গলনাঙ্ক-ফুটনাঙ্ক

১. ধাতু ও আয়নিক যৌগে ল্যাটিস এনথালপির ভূমিকা : ধাতু এবং অয়নিক যৌগের ল্যাটিস বা কেলাস কাঠামোর অধিকারী। এদের গলনাংক-ফুটনাংক নির্ভর করে ল্যাটিস কাঠামোর দৃঢ়তার তথা ল্যাটিস এনথালপির মানের উপর। ধাতুতে ইলেকট্রনের ডিলোকালাইজেশন দ্বারা সৃষ্ট দৃঢ় ধাতব বন্ধন রয়েছে।

ক. চার্জ ঘনত্বের প্রভাব : ধাতু এ ধাতব বন্ধন তথা ইলেকট্রনের ডিলোকালাইজেশন দ্বারা সৃষ্ট স্থির বিদ্যুত আকর্ষন দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে অত্যন্ত দৃঢ় ও বিশাল ত্রিমাত্রিক কেলাস কাঠামো গঠন কারে।  তাই ধাতুর কেলাস বা ল্যাটিস এনথালপির মান অত্যন্ত উচ্চ। উচ্চ তাপশক্তি প্রয়োগ করে এ ল্যাটিস এনথালপির মান অতিক্রম করতে হয় বলে ধাতুর গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক উচ্চ। ধাতর পরমাণর, চার্জঘনত যত বেশি হয় ল্যাটিস এনথালপির মানও তত অধিক হয়। চার্জ ঘনত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক বৃদ্ধি পায়। যেমন: চার্জ ঘনত্বের উচ্চক্রম অনুসারে Na+∠Mg2+∠Al3+ ।তাই Na এর চেয়ে Mg এবং তারও চেয়ে Al এর গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক বেশি। ধাতুর মত আয়নিক যৌগের প্রতিটি আয়ন নির্দিষ্ট সংখ্যক বিপরীত চার্জযুক্ত আয়ন দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে স্থির বিদ্যুৎ আকর্ষণ বল দ্বারা আকৃষ্ট হয় এবং দৃঢ় সংবদ্ধ বিশাল ত্রিমাত্রিক কেলাস কাঠামো গঠন করে। তাই আয়নিক যৌগেরও ল্যাটিস এনথালপির মান উচ্চ। ফলে ধাতুর মত আয়নিক যৌগেরও গলনাঙ্ক-স্ফুটনাঙ্ক উচ্চ । যে যৌগের ল্যাটিস এনথালপি যত বেশি তার গলনাঙ্ক/ফুটনাঙ্কও তত উচ্চ। যেমন- Na+ অপেক্ষা Ca2+ আয়নের চার ঘনতু বেশি। আবার Clঅপেক্ষা O2- আয়নের চার্জ ঘনত্ব বেশি। তাই সামগ্রিকভাবে NaCl অপেক্ষা CaO ল্যাটিস এনথালপিও বেশি। এজন্য NaCl (গলনাঙ্ক 801°C) অপেক্ষা CaO (গলনাঙ্ক 2570°) এর গলনাঙ্ক উচ্চ।

খ.পোলারণ প্রভাব : তবে গলনাঙ্ক-ফুটনাঙ্কের মান সৃষ্ট পোলারণ প্রবণতার উপরও নির্ভর করে। পোলারায়ন যত বেশি হয় যৌগের সমযোজী বৈশিষ্ট তত বৃদ্ধি পায়। ফলে ল্যাটিস এনথালপির মান কমে যায় এবং গলনাঙ্ক/স্ফুটনাঙ্কও হ্রাস পায়। ক্যাটায়ন কর্তৃক অ্যানায়নের ইলেকট্রন-মেঘকে আকর্ষণ করে দুই আয়নের মধ্যবর্তী স্থানে স্থান্তারিত করে শেয়ারের ব্যবস্থা করার বিষয়েরই নাম পোলরণ। এটি নির্ভর করে মুখ্যত ক্যাটায়ন ও অ্যানায়নের চার্জ ও তাক আকারের উপর। সুতরাং বিভিন্ন ক্ষেত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে-

(i) পর্যায়ে-পর্যায় সারণিতে কোনো পর্যায়ে বাম থেকে ডানে ক্যাটায়নের ধনাত্মক চার্জ বৃদ্ধি পায় Na+ < Mg2+ < Al3+ বলে ক্যাটায়ন কর্তৃক অ্যানায়নকে পোলারিত করার ক্ষমতাও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পায়। ফলে সংশিষ্ট যৌগে সমযোজী বৈশিষ্ট্য বৃদ্ধি পায় এবং গলনাংক হ্রাস পায়। যেমন- Na+ অপেক্ষা Mg2+ আয়নের এবং Mg2+ অপেক্ষা Al3+ আয়নের চার্জ ক্রমান্বয়ে বেশি, ফলে ক্রমান্বয়ে পোলারণ বৃদ্ধি পায় বলে Na যৌগ অপেক্ষা Mg যৌগ অধিক সমযোজী এবং Mg যৌগ অপেক্ষা Al যৌগ অধিক সমযোজী। একারণে ক্রমান্বয়ে এদের ল্যাটিস এনথালাপির মান হ্রাস পায়। আর তাই গলনাংক-ফুটনাংকও কমে যায়। তাই গলনাঙ্কের ক্রম NaCl (mp 801°C) > MgCl2 (mp 714°C) > AlCl3 (mp 423°C)।


(ii) জারণ অবস্থা- আবার পরিবর্তনশীল জারণ অবস্থার একই ধাতুর যৌগ যেমন- অনার্দ্র FeCl2 এর গলনাঙ্ক 670°C। কিন্তু অনার্দ্র FeCl3 এর গলনাঙ্ক মাত্র 306°C। এর কারণ Fe2+ আয়ন অপেক্ষা Fe3+ আয়নের চার্জ বেশি। তাই FeCl2 অপেক্ষা FeCl3 এ পোলারণ বেশি। আর এ কারণে FeCl2 এর চেয়ে FeCl3 এ সমযোজী। বৈশিষ্ট্য বৃদ্ধি পায় বলে গলনাঙ্ক কমে যায়। অনুরূপভাবে PbCl2 (mp 501°C) অপেক্ষা PbCl4(mp -15°C). এবং SnCl2 (mp 346°C) অপেক্ষা SnCl4 (mp -33°C) এর গলনাঙ্ক কম SnCl4 ধূমায়িত তরল।

iii) অ্যানায়নের চার্জ– অ্যানায়নের ঋণাত্মক চার্জ বৃদ্ধি পেলেও পোলারণ বৃদ্ধি পায়। ফলে সমযোজী বৈশিষ্টও বৃদ্ধি পায় এবং গলনাংক-ফুটনাংক হ্রাস পায়। যেমন- CaF2 এর গলনাংক 1420°C, অথচ Ca3N2 এর গলনাংক। 1195°C (চার্জ N3-> F)। তবে CaO এর গলনাংক 2570°C হলেও CaF2 এর গলনাংক 1420°C। অর্থাৎ এক্ষেত্রে O2- আয়নের চার্জ F আয়ন অপেক্ষা বেশি হলেও গলনাংকের উপর পোলারণ প্রভাব কাজ করেনি। কারণ O2- আয়নের উচ্চ চার্জ ঘনত্বের কারণে CaO এর ল্যাটিস এনথালপির মান অনেক উচ্চ। তাই গলনাংক খুবই উচ্চ (2570°C)।

(iv) আয়নের আকার- আবার যৌগে পোলারণ ক্যাটায়ন ও অ্যানায়নের আকারের উপরও নির্ভর করে। পার্যায়সাণিতে একটি গ্রুপে উপর থেকে যত নিচে যাওয়া যায় ধাতুর পরমাণুর বহিস্তরে নতুন শক্তিস্তর আসে বলে পরমাণুর তথা ক্যাটায়নের আকার বাড়তে থাকে। তাই পোলারণ ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে বলে যৌগের আয়নিক বৈশিষ্ট্য ও ল্যাটিস এনথালপি বাড়তে থাকে। ফলে গলনাংক বৃদ্ধি পেতে থাকে। যেমন:

গলনাংক (গ্রুপ-২) : BeCl2(405°C) < MgCl2(714°C) < CaCl2(780°C) < BaCl2(963°C)।

(v) গ্রুপে- আবার একটি গ্রুপে উপর থেকে নিচে অধাতুর পরমাণুর আকার বৃদ্ধি পায় বলে (গ্রুপ-17 : F < Cl < Br < I) তা থেকে সৃষ্ট অ্যানায়নের আকারও বাড়তে থাকে। ফলে ক্যাটায়ন কর্তৃক অ্যানায়নের পোলার মাত্রা বাড়তে থাকে। তাই যৌগের সমযোজী বৈশিষ্ট বৃদ্ধি পায় বলে ল্যাটিস এনথালপি হ্রাস পায়। ফলে স্ফুটনাংক হ্রাস পায়। যেমন:

গলনাংক (গ্রুপ-17): CaF2(1420°C) > CaCl2 (782°C) > CaBr2 (720°C) > CaI2 (575°C)

(vi) নিউক্লিয়ার চার্জ-আবার দুটি ক্যাটায়নের আকার ও চার্জ একই হওয়ার পরেও শুধু নিউক্লিয়াসের (প্রেটন সংখ্যা) বেশি হওয়ার কারণে অ্যানায়নের ইলেকট্রন মেঘকে অধিকতর শক্তিতে আকর্ষণ করে। তাই পোলারণ বেশি ঘটে। ফলে সমযোজী বৈশিষ্ট বৃদ্ধি পায় এবং গলনাংক-ফুটনাংক হ্রাস পায়। যেমন:

গলনাংক: CuCl (420°C) < NaCl(801°C)

এখানে Cu+ ও Na+ আয়নের চার্জ একই (+) এবং আকারও প্রায় সমান (~ 0.095 nm)। কিন্তু নিউক্লিয়ার চার্জ (11) অপেক্ষা Cu+ এর নিউক্লিয়ার চার্জ (29) বেশি। তাই CuCl এর পোলারণ মাত্রা NaCl এর চেয়ে বেশি বলে গলনাংক কম।

২. অধাতু ও সমযোজী যৌগে আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বল এর ভূমিকা : অপরপক্ষে অধাতু গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাংক আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বল এর উপর নির্ভর করে। অণুর অণুর আকার যত বৃহৎ হয় ভ্যানন্ডারওয়াল আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বল তত উচ্চ হয়। ফলে গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাংক উচ্চ হয়। যেমন :  মিথেন (CH4), ইথেন, (C2H6) এবং প্রপেন (C3H8) এর অণু ক্রমান্বয়ে বৃহদাকার বলে এদের আন্তঃআণবিক আকষণ বলও পায়। আর তাই মিথেন অপেক্ষা ইথেন এবং তা অপেক্ষা প্রপেন এর স্ফুটনাংক ক্রমান্বয়ে ক্রমান্বয়ে বেশি। P4, S8, Cl2 এবং Ar এর কাঠামো দুর্বল ভ্যান্ডারওয়াল আকর্ষণ বল দ্বারা গঠিত। তাই এদের গলন বা বাষ্পীকরণ এনথাপির মান নিম্ন । এজন্য এদের গলনাঙ্ক-ফুটনাঙ্ক কম। তবে এসব পদার্থের অণুর আকার যত বড় হয় ভ্যান্ডারওয়াল আকর্ষণ বলও তত অধিক হয় বলে অণুর আকার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে গলনাঙ্ক-স্ফুটনাঙ্ক বৃদ্ধি পায়। যেমন- অণুর আকার বিবেচনায়  S8 > P4 >  Cl2 > Ar তাই

স্ফুটনাঙ্ক : S8(445°C) > P4(280 °C) > Cl2(-34 °C) > Ar (-186 °C)

আবার অধাতু বা উপধাতুতেও যদি সংকর অরবিটাল দ্বারা বিশাল ত্রিমাত্রিক কেলাস কাঠামো গঠিত হয় তবে তাকে বিগলিত করতে বা ফুটাতে হলে পরমাণুর চারপাশের সবকটি বন্ধনের বিভাজন প্রয়োজন। আর এজন্য প্রচুর তাপশক্তি প্রয়োগ করতে হয়। তাই এসব পদার্থের গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক খুব উচ্চ। যেমন- C (গ্রাফাইট) ও SI এন গলনাঙ্ক যথাক্রমে 3570 এবং 1414°C। অর্থাৎ গ্রাফাইটের গলনাংক লৌহের প্রায় 2.5 গুণ এবং অধাতু হওয়া সত্বেও সিলিকনের গলনাংক লৌহ ধাতুর গলনাংক (1300°C) অপেক্ষা বেশি।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!