কয়লা: কয়লা হলো 70% এর বেশি অঙ্গারময় (Carbonaceous) পদার্থ এবং দাহ্য এক শ্রেণীর শিলা, ভূগর্ভের তাপ ও চাপের সাহায্যে যা উদ্ভিদের জারণকৃত ফসিল রুপে সৃষ্টি। কয়লার রাসায়নিক সংকেত (C2H4)n। প্রকৃত পক্ষে কয়লা অনেক গুলো অ্যারোমেটিক চক্রের ঘণীভূত যৌগ সেখানে কিছু অসম পরমাণু উপস্থিত থাকে। কয়লার আণবিক সংকেত C29H40O6N ।
ক্যালরিফিক মান: কয়লার মান তার দহন তাপ দ্বারা নির্ধারিত হয়। এক পাউন্ড কয়লা পোড়ালে যত ক্যালরি তাপ উৎপন্ন হয় সেটাই কয়লার দহন মান বা ক্যালরিফিক মান। এর মান সাধারণত BTU(British Thermal Unite) এককে প্রকাশ করা হয়। কয়লার ক্যালরিফিক মান দ্বারা কয়লার গুণাগুণ বিচার করা হয়। যে কয়লার ক্যালরিফিক মান যত বেশি সে কয়লা তত বেশি উন্নত কয়লা হিসাবে বিবেচিত হয়।
BTU: এক পাউন্ড কয়লা পোড়ালে যে পরিমাণ তাপ উৎপন্ন হয়, তাকে সে কয়লার তাপ উৎপাদন ক্ষমতা ধরা হয় এবং একে ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট ((British Thermal Unite = BTU) এককে প্রকাশ করলে যে ক্যালরিফিক মান পওয়া যায় তাকে কয়লার BTU বলে। 1BTU = 252cal.
কয়লা প্রধানত চার প্রকার,যথা:
(i) পিট কয়লা
(ii) লিগনাইট কয়লা
(iii) বিটুমিনাস কয়লা এবং
(iv) অ্যানথ্রাসাইট কয়লা।
এদের মধ্যে পিট কয়লা নিম্নমানের এবং অ্যানথ্রাসাইট কয়লা উচ্চ মানের কয়লা। উদ্ভিদ ও লতাপাতা বিবর্তন ও পঁচনের মাধ্যমে রাসায়নিক পরিবর্তনের ফলে পিট কয়লা থেকে লিগনাইট কয়লা, লিগনাইট কয়লা থেকে বিটুমিনাস কয়লা, বিটুমিনাস কয়লা থেকে অ্যানথ্রাসাইট কয়লাতে রুপান্তরিত হয়।
শিল্প ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বিভিন্ন চুল্লিতে, ইট ভাটায়, তাপ বিদ্যুৎ উৎপাদনে, রেলগাড়ির স্টিম ইঞ্জিনে, হোটেল রেস্তোরা ও বাসগৃহের চুল্লিতে কঠিন জ্বালানিরূপে কয়লা ব্যবহৃত হয়। শিল্পক্ষেত্রে তাপ শক্তি উৎপাদনের জন্য মূলত বিটুমিনাস কয়লাকে অধিক প্রাধান্য দেয়া হয়। অপরদিকে বাসগৃহ জ্বালানিরূপে অ্যানথ্রাসাইট কয়লা ব্যবহার করা হয়।
বিটুমিনাস কয়লাকে 900–1400°C তাপমাত্রায় স্টিম বা বায়ু সহ উত্তপ্ত করে কয়লা থেকে বিভিন্ন জ্বালানি গ্যাস উৎপাদন করা হয়, এ প্রক্রিয়াকে কয়লার গ্যাসীয়করণ বলে। বিটুমিনাস কয়লা থেকে উৎপন্ন গ্যাসীয় জ্বালানি হলো-
(i) কোল গ্যাস
(ii) ওয়াটার গ্যাস
(iii) মিথেন গ্যাস
(iv) সংশ্লেষ গ্যাস ও
(v) প্রোডিউসার গ্যাস।
(i) কোল গ্যাস (coal gas) : বকযন্ত্র বা রিটর্টে বিটুমিনাস কয়লার (10–12% পানি থাকে) অন্তর্ধত পাতন (1000–1300°C-এ) প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন সব উদ্বায়ী পদার্থকে ঘনীভূত করে এবং অবশিষ্ট গ্যাস মিশ্রণ থেকে CS2 কে H2 গ্যাস ও Ni প্রভাবক দ্বারা H2S গ্যাসে রূপান্তর ও সব H2S কে Fe2O3 দ্বারা শোষণ এবং শেষে HCN গ্যাসকে NaOH ও FeSO4 দ্বারা অপসারিত করে, যে গ্যাস মিশ্রণ পাওয়া যায় তা হলো কোল গ্যাস। বকযন্ত্রে অবশিষ্ট রূপে যে কালো গুড়ো পদার্থ পড়ে থাকে, তাকে কোক (Coke) কার্বন বলে।
কোল গ্যাস মিশ্রণে মিথেন (CH4), H2, CO2 ইথিলিন(C2H4), অ্যাসিটিলিন(C2H2), বেনজিন বাষ্প (C6H6) ও N2 গ্যাস মিশ্রিত থাকে।
কোল গ্যাসের ব্যবহার :
কোল গ্যাস জ্বালানি হিসেবে বিভিন্ন শিল্পে তাপ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। বিভিন্ন শহরে আলো উৎপাদকরূপে এবং ধাতু নিষ্কাশনে বিজারক পরিবেশ সৃষ্টিতে কোল গ্যাস ব্যবহৃত হয়।
কোক (coke) কার্বনের ব্যবহার :
কোক কার্বন দৈনন্দিন কাজে জ্বালানি হিসেবে, ধাতু নিষ্কাশনে বিজারকরূপে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া কোক কার্বন প্রোডিউসার গ্যাস ও ওয়াটার গ্যাস উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।
(ii) ওয়াটার গ্যাস (Water gas) : লোহিত তপ্ত কোক কার্বনের ওপর দিয়ে স্টিম চালনা করে ওয়াটার গ্যাস উৎপাদন করে। ওয়াটার গ্যাস হলো সম-মোলার কার্বন মনোক্সাইড (CO) ও H2 গ্যাসের মিশ্রণ।
বাস্তবে এ গ্যাসের মধ্যে স্বল্প পরিমাণে CO2, CH4 ও N2 গ্যাস ভেজালরূপে থাকে। ওয়াটার গ্যাসের H2 উপাদানটি নীল শিখাসহ জ্বলে ওঠে বলে ওয়াটার গ্যাসকে
ওয়াটার গ্যাসের ব্যবহার : বিভিন্ন শিল্পে চুল্লির জ্বালানি হিসেবে ওয়াটার গ্যাস ব্যবহৃত হয়। ধাতু নিষ্কাশনে বিজারকরূপে ওয়াটার গ্যাস বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া CH4 গ্যাস ও মিথানল উৎপাদনে ওয়াটার গ্যাস ব্যবহৃত হয়।
(iii) মিথেন গ্যাস উৎপাদন : লোহিত তপ্ত কোক কার্বনের ওপর দিয়ে স্টিম চালনা করলে ওয়াটার গ্যাস উৎপন্ন হয়। পরে ওয়াটার গ্যাস ও সমআয়তন H2 গ্যাসের মিশ্রণকে 300°C তাপমাত্রায় উত্তপ্ত Ni চূর্ণের ওপর দিয়ে চালনা করলে মিথেন (CH4) গ্যাস ও পানি বাষ্প উৎপন্ন হয়। উৎপন্ন গ্যাস মিশ্রণকে শীতল করলে পানি বাষ্প তরল পানিতে পরিণত হয়। শেষে মিথেন গ্যাস পাওয়া যায়।
মিথেন CH4 এর ব্যবহার : মিথেন গ্যাস জ্বালানি হিসেবে এবং ইউরিয়া সার উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।
(iv) সংশ্লেষ গ্যাস (Synthetic gas) : মিথেন গ্যাসকে স্টিম সই উচ্চ চাপে ও প্রায় 900°C তাপমাত্রায় উত্তপ্ত Ni প্রভাবকের ওপর চালনা করলে সংশ্লেষ গ্যাস উৎপন্ন হয়। সংশ্লেষ গ্যাস হলো এক মোল CO গ্যাস ও তিন মোল H2 গ্যাসের মিশ্রণ ।
সংশ্লেষ গ্যাসের ব্যবহার: সংশ্লেষ গ্যাস শিল্পাক্ষেত্রে জ্বালানি ও বিজারক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া
মিথানল উৎপাদন করা হয়।
(v) প্রোডিউসার গ্যাস (Producer gas) : লোহিত তপ্ত কোক কার্বনের ওপর দিয়ে 100°C তাপমাত্রায় বায়ু চালনা করলে মূলত CO গ্যাস ও N2 গ্যাসের মিশ্রণ পাওয়া যায় তাকে প্রোডিউসার গ্যাস বলে। এ গ্যাস উৎপাদনের স্টিল নির্মিত চুল্লির নাম হল প্রোডিউসার । এ চুল্লির নামানুসারে এতে উৎপাদিত গ্যাসটির নাম হয়েছে প্রোডিউসার গ্যাস।
প্রোডিউসার গ্যাসের ব্যবহার: স্টিল, কাচ প্রভৃতি শিল্পে চল্লি উত্তপ্ত করার জন্য প্রোডিউসার গ্যাস ব্যবহৃত হয়। কোল গ্যাস উৎপাদনে বক-যন্ত্রকে উত্তপ্ত করার জন্য প্রোডিউসার গ্যাস ব্যবহৃত হয়। এছাড়া ধাতু নিষ্কাশনে এটি বিজারক ব্যবহৃত হয়।
জেনে নাও :
(১) কোল গ্যাসে থাকে → মিথেন (CH4), H2, CO2 ইথিলিন(C2H4), অ্যাসিটিলিন(C2H2), বেনজিন বাষ্প (C6H6) ও N2 গ্যাস।
(২) ওয়াটার গ্যাসে থাকে → 1:1 মোল অনুপাতে CO ও H2 গ্যাস। (কোক ও স্টিম থেকে)
(৩) সংশ্লেষ গ্যাসে থাকে → 13 : 3 মোল অনুপাতে CO ও H2 গ্যাস। (মিথেন ও স্টিম থেকে)
(৪) প্রোডিউসার গ্যাসে থাকে → 2:1 মোল অনুপাতে CO ও N2 গ্যাস। (কোক ও বায়ু থেকে)