এসিড বৃষ্টি কী?

যে বৃষ্টির পানিতে নানাবিধ অম্লধর্মী অক্সাইড বা এসিড মিশ্রিত থাকার কারণে ঐ বৃষ্টির পানির pH < 5.6 হয় সে বৃষ্টিকেই এসিড বৃষ্টি বলে। বৃষ্টির পানির সঙ্গে এমনিতে সচরাচর CO2 দ্রবীভূত থাকে যার ফলে H2CO3 উৎপন্ন হয়।

CO2(g) + H2O(1) →  H2CO3

H2CO3(aq)  → H+ + HCO3

pH = 5.6

এ H2CO3 এর আয়নিকরণের কারণে বৃষ্টির পানিতে যে H+ আয়ন উৎপন্ন হয় তাতেই বৃষ্টির পানির pH = 5.6 হয়ে যায়। তবে pH

এর মান 5.6 এর চেয়ে কমে গেলে অর্থাৎ বৃষ্টির পানি আরও এসিডীয় হলে তখনই ঐ বৃষ্টিকে এসিড বৃষ্ট বলা হয়।

এসিড বৃষ্টির কারণ:

মানুষ নিজের জীবনকে সুখময় করার জন্য তৈরি করছে প্রচুর সংখ্যক শিল্পজাত দ্রব্য যার ফলে দিন রাত জ্বলছে শিল্প কারখানার চিমনি। এসব চিমনি দিয়ে পরিবেশে অনবরত নির্গত হচ্ছে ফ্লু-গ্যাস যাতে থাকে হাইড্রোজেন সালফাইড, সালফার ডাই অক্সাইড ও সালফার ট্রাই অক্সাইডের মত ক্ষতিকর গ্যাসসমূহ। সবচেয়ে বেশি (প্রায় 60%) সালফার ডাই অক্সাইড নির্গত হয় পৃথিবীর বিভিন্ন তাপ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে। এছাড়া তেলশোধনাগার, সালফিউরিক এসিড ও নাইট্রিক এসিড উৎপাদন কেন্দ্র থেকে ব্যাপক হারে SO2 ও NO2 নির্গত হয়ে বায়ুতে মিশছে। সর্বোপরি খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আমরা মাটিতে ব্যাপক হারে যে ইউরিয়া সার ব্যবহার করছি তার বেশ কিছু অব্যবহৃত অংশ বিয়োজিত হয়ে নাইট্রোজেন অক্সাইড উৎপন্ন করে যা বায়ুতে মিশে যাচ্ছে। নাইট্রোজেন এবং সালফার এর এসব অক্সাইড বৃষ্টির পানিতে মিশে তৈরি করছে এসিড। এসিড মিশ্রিত এ বৃষ্টিই এসিড বৃষ্টি।

NO2   +  O2  +  H2O   →    HNO3

SO2   +   H2O           →     H2SO3

SO3   +   H2O           →     H₂SO4

এসিড বৃষ্টির প্রভাব :

১. সাধারণত পানির pH এর মান যেখানে 7 সেক্ষেত্রে কোন কোন স্থানে এসিড বৃষ্টির কারণে পানির pH এর মান এ নেমে যেতে দেখা যায়। আর এ তীব্র এসিড বৃষ্টি’ পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। জলাশয়ের মাছ মরে যায় এবং মাটিতে কোন ফসল ফলে না।

২. দালানকোঠা-স্থাপনা ব্যাপকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। রিপোর্টে প্রকাশ ভারতের মথুরায় তেল শোধনাগার থেকে নির্গত SO2 এর প্রভাবে এবং সৃষ্ট এসিড বৃষ্টিতে আড়াইশ’ কিলোমিটার দূরের আগ্রার তাজমহলের শ্বেত পাথর হলুদ হয়ে যাচ্ছে, ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে।

৩. ধাতু দ্বারা নির্মিত সেতু, জাহাজ, যানবাহন কোনটিই এসিড বৃষ্টির ক্ষয় থেকে রক্ষা পায় না।

৪. এসিড বৃষ্টিতে অরণ্যের গাছপালা ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। এটি যে মারাত্মক হতে পারে তার সাম্প্রতিক নজির হলো গত শতাব্দীর শেষ দিকে আমেরিকার ভার্জিনিয়া এবং ইউরোপের সুইডেনে এসিড বৃষ্টিতে pH=2 এর নিচে নেমে যায় এবং বনাঞ্চল ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

৫. এমনকি অধিক অম্লত্বের কারণে শস্য বীজের অঙ্কুরোদগম এবং জলাশয়ে মাছের ডিম হ্যাচিং বাধাগ্রস্ত হয়।

৬. ভূত্বকের প্রধান উপাদান Ca Mg Al এবং Zn এর যৌগগুলো এসিড বৃষ্টিতে দ্রবীভূত হয়ে ধুয়ে যায়। ফলে জমিতে অনুর্বরতা সৃষ্টি হয়।

এসিড বৃষ্টির প্রতিকার :

পরিবেশের উপর এসিড বৃষ্টির ব্যাপক বিরূপ প্রভাবকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনা যায়।

১. ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট : বিভিন্ন শিল্প কারখানা ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চিমনি দিয়ে ক্ষতিকারক সালফার ডাই অক্সাইড ও গ্যাসসমূহ নির্গত হওয়ার আগে তাকে ফু-গ্যাস ডিসালফিউরাইজেশন প্ল্যান্টে (FGD) চুনাপাথর বা চুনের মধ্যে চালনা করে SO2 শোষণ করে রাখা হয়। এতে ক্ষতিকারক সালফার ডাই অক্সাইড অপসারিত হয়। ফলে দূষণের হাত থেকে পরিবেশ রক্ষা পেতে পারে। ক্ষারের সঙ্গেও বিক্রিয়া দ্বারা সালফার ডাই অক্সাইড গ্যাস শোষণ করে রাখা যায়। এ উদ্দেশ্যে নিম্নের বিক্রিয়াসমূহ ব্যবহার করা হয়।

CaCO3(s)   +    SO2(g)    →   2CaSO3(s)   +  CO2(g) 

 CaO(s)      +    SO2(g)     →    2CaSO3(s)

2CaSO3(s)  +  O2(g)  +   4H2O(1)  →  2(CaSO4.2H2O)

২. রিসাইক্লিং: এছাড়া শিল্প কারখানার এসব বর্জ গ্যাস চিমনি দিয়ে পরিবেশে ছেড়ে না দিয়ে প্রক্রিয়াতে পুনসঞ্চালন (recycle) করে কাজে লাগানো যায়। যেমন SO3 ও NO2 কে সংশ্লিষ্ট শিল্প কারখানায় পুনসঞ্চালন করে প্রয়োজনীয় এসিডে রূপান্তর করা যায়। যেমন:

SO2   +   O +   H2O   →   H₂SO4

NO₂   +  O2  +   H₂O   →  HNO3

এছাড়া মিথেন দ্বারা SO2 গ্যাসকে বিজারিত করে H2S-এ পরিণত করা যায়। এ H2S এবং SO2 কে আবার Fe2O3 প্রভাবকের উপস্থিতিতে সালফারে পরিণত করে তা থেকে H₂SO4 উৎপাদন করা যায় ও পুনঃব্যবহার করা সম্ভব।

SO2  +  CH4   → CO2 + H2S

S  +  O2  →  SO2

H2S  +  SO2  →  S  +  H₂O

SO2 +  O2  +  H₂O  →  H₂SO4

৩. অটো এক্সস্ট ট্রিটমেন্ট : অটোমোবাইল ইঞ্জিনে জ্বালানির অসম্পূর্ণ দহনে সৃষ্ট CO ও N অক্সাইডকে ক্যাটালাইটিক কনভার্টারে V2O5 এর প্রভাবে কম ক্ষতিকর CO2, N2-এ পরিণত করা হয়।

CxHy  +  CO2  +  NO  +  O2    →   CO2  +   N2  +  H2

৪. গণসচেতনতা : এভাবে শিল্প কারখানার ক্ষতিকর বর্জ গ্যাসগুলোকে পরিবেশ থেকে দূরে রেখে যেমন পরিবেশকে বাঁচানো যায় তেমনি পরিবেশ রক্ষার আর একটি পন্থা হলো গণসচেতনতা বৃদ্ধি। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন বা বিভিন্ন ধরনের সামাজিক আন্দোলন যা আমাদের দেশে বেলা’ বা বাপা’ করে থাকে এসব আন্দোলন দ্বারা যেমনি ব্যক্তিগত বা সামাজিক পর্যায়ে মানুষকে সচেতন করা যায় তেমনি সরকার বা শিল্প কারখানা মালিকদেরও এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উদ্বুদ্ধ করা যায় বা এমনকি প্রয়োজনে বাধ্য করা যায়। এর ফলে একদিন পরিবেশ এসিড বৃষ্টির ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে পারে।

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!